রবিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২১

শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

কন্যার জ্বরে বাপের গতর পুড়ে। বুঁকে গন্ধ ফুঁটে। কলজে পুড়া গন্ধ। কন্যা, তাহাজ্জুদে বাপের পুড়া গন্ধ উপভোগ করে প্রাণভরে।
ভাবে, এমন পুড়া তো কন্যারও বাপের অসুখে পুড়ে। 

গত দুইদিন ধরে অসুখে, নির্ঘুমে দিনাতিপাত করছি।  মস্তিষ্ক চুপ হয়ে আছে। স্বাদের কানাকড়িও জিহ্বায় পাচ্ছিনা। মজার বিষয় কি, জ্বরে সব ফলকে আমার 'আমলকি-আমলকি' মনে হয়। নিখাদ তিতা। 

আসর ওয়াক্ত।  বিছানা ছেড়ে  কিছুক্ষন আকাশ দেখার ফুসরত হলো। অসুস্থ অবস্থায় সারাক্ষণ বিছানায় শরীরকে ঝিঁইয়ে রাখা, অসুস্থতাকে আরো বাড়িয়ে দেয় বলে মনে হচ্ছে। তার-উপর আকাশ না দেখার বেদনা। আদ্যোপান্ত, অসুখ আমার কাছে অসুখই।  

আধশোয়া হয়ে ভাবছি, যদি জানালা ঘেসে আকাশ ছোঁয়া যেতো, তবে ছুঁয়ে দিতাম। আকাশও তার সবটুকু নীলে আমায় ছুঁয়ে দিত। আলগোছে চোখ বুঝতাম, আকাশ আমার জ্বর ভালো করে দিতো। 

ও নীলচে আকাশ...........
আমার জ্বরটুকু ভালো করে দাও, 
তোমার সবটুকু দিয়ে। 

১৪/০৮/২১

বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১

ল্যান্ডফোনে ভেসে আসে আমাদের মন খারাপের সংবাদ। মিস ইউ তাইফ বাবা। 

১১/০৮/২১

মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট, ২০২১

আমি ছুটি, টাট্টুঘোড়ার মতো ছুটি।
১০/০৮/২১
ইশ! কেউ যদি হুমায়ূনের উড়ে যায় বকপক্ষী নাটকের তৈয়ব হতো। বাড়িতে যখন কেউ থাকবে না, তখন গোলাপের বদলে মুরাদনগরের এক জোড়া মিঠা লাউ হাতে সে আমার বাড়িতে আসবে।

তারপর আমাকে ফিসফিস করে বলবে,
কৈতরি, তোমাকে তো আইজকা অত্যধিক সৌন্দর্য লাগতেসে। ঘটনা কী? সিনান করেছো নাকি? 

কিছু কিছু মুহুর্তের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে বুকেরলিপিতে, সেখানে দিনলিপির খুচরো পাতা নেহাৎ খসখসে মনে হয়। 

জানো তো; মসৃণ-মোলায়েম বুকেরলিপিও মাঝেমধ্যে উল্টেপাল্টে পড়া যায়, ছোঁয়া যায়।

তোমাকে 'তৈয়ব'।  

০৯/০৮/২১

রবিবার, ৮ আগস্ট, ২০২১

নালিশে-বালিশে আসমান ভিজে উঠুক বারংবার। জুলেখা, আমি না হয় চড়ুইভাতি হয়েই বাঁচি, তুমি মেঘের জামিনদার। 

০৮/০৭/২১ 

শনিবার, ৭ আগস্ট, ২০২১


সারাদিন এক নাগাড়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মানুষেরা হয়তো রাতের খাবারটা খুব আয়েশ করে আরামসে, পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে খেতে পছন্দ করে। 

আমাদের কর্পোরেট বাসায় সেই নিয়মই চলে। খেতে খেতে রাষ্ট্রীয় সব আলাপ চলে, চলে রাজনৈতিক কথাবার্তাও। বেকারদের সাথে চলে চাকরি নিয়ে আলোচনা, পড়ুয়াদের সাথে চলে পড়াশোনার সিরিয়াস কথাবর্তা। ফাঁকেফাঁকে সংলাপের মতো উঠে আসে- খেলাধুলা থেকে হেঁশেল, গণপরিষদ  থেকে আবহাওয়া,  সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত। 

খেতে খেতে আচমকা মনে পড়ল, 
বিস্রস্ত জর্নালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার লিখেছিলেন- জীবনে সমস্যা আর সংগ্রামের সঙ্গে যে যুদ্ধ করে সে নায়ক। ভিলেন সে, যাকে এটা করতে হয় না। 
খাবার টেবিলে চুপিসারে একজনের সাথে দীর্ঘ আলাপ। যিনি নায়ক হয়ে ভাসছিলেন আমার চোখের সামনে। সাক্ষাত নায়ক। আব্বু। আমাদের চোখেরসুখ, আমাদের নায়ক।  

আসলে, মানুষ তার যাপিত জীবন থেকে যা শেখে পুঁথিগত বিদ্যা তা শেখায় না। কোনদিন না।

০৭/০৮/২১

শুক্রবার, ৬ আগস্ট, ২০২১

বৃহস্পতিবার, ৫ আগস্ট, ২০২১

বাংলা ইংরেজি পড়ানো মাষ্টার বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে তিনঘন্টা লেকচার দিলো, ভাবা যায়? 
এই দুঃসাহস টা প্রতি বৃহস্পতিবার আমাকে দেখাতে হয়।  ছোটোবোনটাকে মেঝোবোন নিয়মিত গনিত আর বিজ্ঞান পড়ায়। এখানে আমি ইন্সট্রাকটর পদে কাজ করি। প্রতি বৃহস্পতিবারে চেক করি, কে কি পড়ালো না পড়ালো, কতটুকু আয়ত্ত করলো বা না করলো। তারপর দুইপক্ষের অভিযোগ শুনি। শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রের, ছাত্রের বিরুদ্ধে শিক্ষকের।  দুই পক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে  টানা দুই-তিন ঘন্টার একটা স্পিচ রাখি। ব্যাপরটা যত সহজ ভাবছেন তা না। ব্যাপারটা বিশাল ঝক্কির। 

যথারীতি আজ বৃহস্পতিবার।  নিয়মানুসারে আমার ঝক্কি পোহানোর দিন। রাত ৮টায় বসলাম ১১ টায় উঠলাম। আমার হাতের ডানপাশ আর বামপাশ সিরিয়াস মুডে ভরপুর তখন। নো স্মাইলের বাতাস। দীর্ঘ তিনঘন্টা আনুষ্ঠানিক ঝড়ের পর তাদেরকে বললাম; শোনো শাষন করা তারই সাঁজে সোহাগ করে যে। 

তারা বলল - শুভ রাত্রি,
হ্যাভ এ্যা গুড স্লিপ। 

০৫/০৮/২১


বুধবার, ৪ আগস্ট, ২০২১

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এবারের সিরিজে বাংলাদেশ পরপর দুইবার ম্যাচ জিতলো, এটি ক্রিকেট ভক্তকুলের জন্য নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চিত একটি ব্যাপারস্যাপার। তবে এবার পালা অপেক্ষার, সিরিজ জয়ের অপেক্ষা।  
একটা বিষয় আমি নিজক্ষেত্রে বরাবর খেয়াল করি, কোনো দুঃখের সংবাদ শুনলে যেমন আমার ঘুম হয় না, তেমনি আবার খুশির সংবাদ শুনলেও আমার ঘুম হয় না। অদ্ভুত এক যন্ত্রণা, মিষ্টি যন্ত্রণাও বলা চলে।
রাতটা যদি ঘুমেই না কাটাতে পারলাম, হেলায় কাটানোরও কোনো যুক্তিগত কারন দেখছি না। তাই, সাপ্তাহিক বুক রিভিউ লিখতে বসব ভাবছি.........

যাক পরসংবাদ,
সক্কাল সক্কাল আকাশজুড়ে একগাল প্রেমের পদ্য দেখছিলাম, সাথে হাল্কা বিষাদের পাঁচফোড়ন। আজকের দিনের শুরুর আকাশটা ছিলো নীল মেঘেরঘটা। প্রতিদিনই আকাশ দেখি আর বলি 'আজকের মতো সুন্দর আকাশ আমি আর দেখি নাই'। 
আমার হৃদয়ে আকাশ হাসে, 
খিলখিলিয়ে হাসে; 
তারপর ভোর হয়-
নিয়মমাফিক আলো ফুঁটে, 
আমিও ফুঁটি;
রোজ কুসুমের মতো। 

সকালে টুকটাক কাজের পর লম্বা একটা আড্ডা দিলাম, এক নাগাড়ে দুপুর পর্যন্ত। দুপুরের দিকে আকাশে কড়া রোদ। গরমে-ঘামে একাকার অবস্থা।  বিকেলে রং-চা। সাঈদ-সাজ্জাদের আম্মু খুব দারুণ (পারফেকশন) 'রং-চা' বানালেন। লেবু আর আদার পারফেক্ট  কম্বিনেশনে।
রং-চার স্বাধ ঠোঁটে নিয়ে ঘরে ফিরলাম। ভবঘুরে পাখিরাও নাকি ঘরে ফিরেছে। 

০৪/০৮/২১  

Wishlist

100 things I want to Do before I Die. (Insallah)
-Salmon Salma


1. Write Daily opinion/blog

2. Walks in the morning

3. Reading (at least) 307 Books

4. Reading 'The Kanzul Iman' translation of Holy Quran.

5. Reading 'Al Mawahib Laduniya' properly

6. Learning 'Calligraphy' (Bangla, English, Arabic)

7. Reaching expert level in typing

8. Learning 30 Surah by heart

9. Learning Self-defense techniques.

10. Taking online course on fitness

11. Taking online course on psychology

12. Taking online course on project management

13. Taking online course on Successful Negotiation: Essential strategies and skills

14. Reaching expert in Graphic design

15. Taking online courses on writing

16. Learn 'Bhuna Khichuri and Kosha Mangsho (Mutton curry)' from ABBU

17. Watching Sunrise and Sunset regularly

18. Talking with Abbu and my siblings regularly

19. Taking a week break from using mobile

20. Staying out of Facebook for a month

21. Complete silence for 24 hours

22. Getting an Honor’s degree

23. Getting Master's degree

24. Fluency in three languages

25. Scoring at least 7.0 in IELTS

26. Studying abroad. (Master's in Japan)

27. Teaching in a primary school of Japan

28. Tour - Sirikot Shareef

29. Tour - Ajmer Shareef

30. Tour - Bareilly Shareef

31. Tour - Sundarbans-Mangrove Forest

32. Tour - Srimangal

33. Tour - Ratarghul Swamp Forest

34. Tour - St. Martin Island

35. Tour - Taj Mahal. (Agra, India)

36. Tour- Bangladesh National Parliament

37. Vote in a National Election

38. Visiting and spending quality time at nearest Retirement home (Briddhashrom)

39. Seeing Everest view from Tetulia, Panchagarh

40. Attending a 'Sufism festival'

41. Attending 'Poush Mela' in Santiniketan

42. Visiting Kolkata book fair

43. Working for 'Plant project' (at least 7times)

44. To be a BCS cadre

45. Take my two sisters’ (Sayma & Arifa) on their Dream vacation.

46. Abbu and I performing Hajj together

47. Meeting Na'ima B Robert in person

48. Meet and Talk with 50 strangers

49. Take (at least 20) Homeless child to breakfast

50. Getting Married

51. Go Skydiving

52. Going to the wonderful resort and enjoy holiday with my family

53. Maintaining ideal body weight

54. Watching any cricket match at Eden Garden, Kolkata

55. Capturing (at least 100) Street photography

56. Internationally participating in photograpy contest (at least 5 times) [*ISTANBUL photo awards and *ZEISS photograph AWARD]

57. Become a 'Mentor' to someone in need

58. Writing a list of 25 advices for Sayma & Arifa

59. Writing 101 book reviews

60. Wedding of Atik

61. Wedding of Opu

62. Wedding of Sayma

63. Wedding of Jannat

64. Wedding of Arifa

65. Starting an website

66. Recording 50 poems in my voice

67. Learning to drive a car

68. Helping (as many as possible) depressed persons

69. Dedicating my first book to my parents.(Abbu and Amma)

70. Writing a Book (Novel)

71. Writing a book. (Poetry)

72. Writing a biography of Imam Abu Hanifa

73. Translating (English to Bengali):'Bengal Towards The close of AURANGZIB'S
REIGN'

74. Arranging 21st marriage anniversary of Apa & Dulabhai.

75. Buying a Typewriter

76. Work for 'free education'

77. Work/volunteer at UNICEF

78. Work for Development of education

79. Giving a speech in front of 1000 people

80. Work at 'UN WOMEN'

81. Helping two people to achieve one of their goals

82. Interviewing with interesting people.

83. Work at 'Save the Children'

84. Owning a Business

85. Set up a local library (Chinmoy Boighar) for open to read

86. Create online book library

87. Make an own energetic team

88. Meet and enjoy 50 kids together

89. Seeing the sky at least 10 minutes/day

90. Lecture in (at least) 5 School/Colleges/Madrasah.

91. Attend/Give a live TED talk

92. Give (at least 25) paid speech

93. Buying 'Nazrul Rachanabali'

94. Buying 'Ahmed Sofa Rachanabali'

95. Writing a letter each (when I'm 35) with a surprise gift to my 5 friends.

96. Riding a Horse

97. Making a Family photo-book with description

98. Learn a Strategy Game

99. Celebrating 50th anniversary of IKRA SCHOOL & COLLEGE

100. Becoming a Strong Person, Confident, Mature, Leader.



(If any of my friends can help me in achieving any of these goals, please let me know. Your help is always welcome. And of course let me know your goals too. THANK you)

মঙ্গলবার, ৩ আগস্ট, ২০২১

আজকে সকাল থেকেই নিজেকে খুব পরিপাটি লাগছে। 
আমি আমার জীবনের ১০০টি ইচ্ছার ব্যাপারে আজ থেকে ওয়াকিবহাল। ব্যাপারটা খুব মজার। একটা ছোট ঘটনা বলি, একবার এক লোক কোথাও একটা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, আচ্ছা আপনার ২৫ টি ইচ্ছের কথা বলুন তো যা আপনি পূরণ করতে চান। সেদিন খুব সময় নিয়েছিলাম, প্রচুর ভাবতে হয়েছিলো। ব্যাপরটা চমৎকারভাবে নিজের প্রতি উদাসীনতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হলো। 

এখনো যে নিজেকে আহামরি গুছিয়ে  ফেলেছি তা না। তবে নিজের ১০০টি ইচ্ছের কথা গড়গড় করে বলে দিতে পারবো, এটা খুব স্বস্তি দিচ্ছে। তাই খুব ফুরফুরা আছি সকাল থেকে। নিজেকে সময় দেওয়া প্রতিটি প্রাণের প্রয়োজন। নিজেকে সময় দিলে নিজেকে ঘষামাজা করার পথ গুলো খুলে দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে আগামি টা উৎসবমুখর হয়। বাতাসে সুখ বয়। 

যাগ্গে সকালটা কাটালাম তৃপ্তির ঢেকুর তুলে, স্বস্তির সাথে। 
 
দুপুর দিকে পরিচিত একজন অসুস্থ শুনেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাসা থেকে বেশ দূরে। টের পেলাম যাত্রাটি সুখকর না। নিয়মমাফিক ভোগান্তিতে পড়তে হলো। কাঠখোড় পুড়িঁয়ে গেলাম। দেখলাম। কথা হলো। শান্তি লাগছে।
আচমকাই নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকালাম। দেখি, আসরের ওয়াক্ত হলো, কিন্তু আযান শুনছি না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। যদিও নামাজের সময়টা আমি জানি। তারপরও আযান শুনে নামাজে দাঁড়ালে কেমন যেনো নিজের ভিতরে একটা উদযাপন উদযাপন ফিল হয়।
 
যাই হোক মিনিট পাঁচেক পর ওখানকার একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি আযান টা মিস করেছি? আযান হয়ে গেছে? 
তারপরের উত্তর শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।  তিনি বলেন আমাদের এখানে মাইকে আযান দেয় না।  আর মসজিদ আমাদের বাসা থেকে দূরে, তাই মুয়াজ্জিনের সুর আমাদের ঘর অবধি আসে না। আমরা অনেকবছর আযান শুনি না। 

আমি হতবম্ব হলাম। ভাষাহীন। আমার তো কোনো দিন কাটে না মুয়াজ্জিনের ওই দরদমাখা ডাক ছাড়া। তখন ভাবছি এমন দরদ থেকে বঞ্চিত হওয়া হৃদয়ের কথা। এমন অমৃতস্বর, এমন স্নেহময় আবেদন আর কোথাই পাই আমরা! আযান শুনতে না পাওয়া হৃদয়ের হালচালের কথা ভাবতে ভাবতে দু'টা লাইন আওড়ালাম;

মুয়াজ্জিনের ডাকে; 
আমার হৃদয় দুলে-
দোদুল দুল্ দোদুল দুল দোদুল দুল!
 
০৩/০৮/২১

সোমবার, ২ আগস্ট, ২০২১

আযান শুনেই যথারীতি ঘুম ভাঙ্গলো। মুয়াজ্জিনের দরদমাখা ডাক। আমি মনে করি,  সকাল দেখতে পারা একটা নেয়মত। এই নেয়ামতের স্বাদ নিতে পেরে আমি বরাবরই আনন্দিত, পুলকিত। 
ফজরের পর নিজের রুটিনে কয়েকবার চোখ বুলালাম। নিয়মিত আকাশ দেখে আমি আমার চোখের শখ পূরণ করি। এটিও খোদার চমৎকার উদারতা। আকাশ দেখলাম। 

বেলা গড়ালো, টেবিল টানছে কাজের জন্য। জীবনে ডুকতে তার এই চাপ।  তাছাড়া আজকাল পড়াশোনারও খুব চাপ চলছে। তবে আমি একটা দাওয়াই নেই, যখন কোন কিছুর প্রেশারে থাকি তখন মনে মনে তসবিহর মতো জপতে থাকি 'চাপই জীবন, জীবনই চাপ'। থিয়োরিটা অনেকটা থ্রীডিয়টস মুভির আমির খানের 'অল ইজ ওয়েল' এর মতো। 

নাওয়াখাওয়া শেষ। এখনো বিকেল হয়নি। তবে বিকেল আমার জন্য সবসময়  বিষাদ নিয়ে আসে। কারা যেনো বলে, সন্ধ্যায় সব পাখি ঘরে ফিরে। 
কেবল আমার ঘরেই 'তিনি' ফিরে না।
সন্ধ্যার নীল নিয়ে রাত্রিজাগরণ, তারপর ওই ভোরের নিকটে বসবাস। এক জীবনে এই বা কম কিসের!  সুখ, শান্তি, বিষাদ সবটুকুই তো আল্লাদ। 

০২/০৮/২১ 

রবিবার, ১ আগস্ট, ২০২১

ফেরা - ৩য় পর্ব।



অনেকদিন বাদে রাত্রিরে বেশ ভালোই ঘুম হলো৷  নিশ্চিন্ত মস্তিষ্কের ঘুম।  দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম, সময় ৫ঃ৪৫।  বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম৷  মা'কে খুব মনে পড়ছে৷  না জানি কি করছে৷  আসার সময় দেখে এসেছি মায়ের চোখ দুটো ছলছল, একফোঁটা অশ্রুপাত হয়নি৷  তবে কি মায়ের অশ্রুবিসর্জন আমার অনুপস্থিতিতে হয়৷
  
মা'গো তোমাকে ভীষন মনে পড়ছে।  
পাখির শব্দ।  স্রষ্টার অদ্ভুত সৃষ্টি।  রোজ সকালে মানুষের ঘুম ভাঙ্গানো এদের কাজ৷  খিটখিটে শব্দ নয়, মধুমাখা শব্দ।  কানে সুড়সুড়ি দিয়ে জাগিয়ে তোলে।  অলস সকাল-ও  সক্রিয় হয়৷        
জানালার ঘা ঘেঁসে অাসছে সুরভী সুভাস৷  এই বাড়ির সব কিছুই অামাকে মুগ্ধ করছে৷  অাচমকা দরজায় ঠকঠক শব্দ৷  রাফির অাগমন৷  উচ্চস্বরে বলছে 'স্যার বাবা ডাকছে, নাস্তা করার জন্য৷ 

অামি গিয়ে দরজাটা খুললাম।  
রাফিঃ স্যার বাবা অপেক্ষা করছে অাপনার জন্য।  অাসেন৷  
অামিঃ তুমি যাও৷ স্যার অাসছি৷  
অাব্বা মারা যাওয়ার পর অার পরিবারকে নিয়ে একসাথে বসে নাস্তা করা হয়নি৷  খুব টানাটানির সংসার ছিলো৷  সে এক অন্য পরিক্রমা। 
অান্টি টেবিলে নাস্তা দিলেন।  উর্মি-ও এগিয়ে দিচ্ছে থালা৷  মার নেউটা বলে কথা৷  খুব নাজুক অবস্থা অামার৷  
খেতে খেতে চাচা জিঙ্গেস করলেন; কাল রাতে কেমন ঘুম হলো?  
অামি খাবার মুখেই মাথা নেড়ে জবাব দিলাম জ্বী চাচা বেশ ভালো৷  
অান্টি রান্নাঘর থেকে বলছে শোনো তোমার কোনো অসুবিধা হলে অামাকে বলবে।  
পাশ থেকে রাফিও বলে উঠল স্যার অামাকেও বইলেন৷  
অামি মৃদুস্বরে হাসলাম৷  চোখ উঠাতেই দেখলাম অাড়চোখে উর্মির দৃষ্টি৷  অামি রীতিমতো সংকোচিত হলাম।  অামার কথা যদি বলি ছিপছিপে গড়নের সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ করা, লোকে দেখলেই বুঝে যায় চরানচলে অভাব অনটন পরিবারের বড় ছেলে৷  যার মস্তিষ্কে পাহাড়সম দায়িত্ব।  
নাস্তাপর্ব শেষ। সকাল নয়টার নাগাদ দরজার ওপাশে রাফি অার অারফান।  
স্যার অাসবো? 
হ্যা হ্যা অাসো৷  
ওরা পড়তে এসেছে।  অামি পড়ানো শুরু করলাম।  রাফি যথারিতি অস্থিরতাভাব প্রকাশ করছে।  
অামি রাফিকে জিঙ্গেস করলাম উর্মি কোথাই? পড়বে না? 
রাফির ছটফটা উত্তর; স্যার অাপুর স্কুল সকাল ৮টা থেকে।  
ওহ ; অাচ্চা পড় তোমরা৷ । 

ওদের বাড়ির গেইটের ভিতরে বিশাল বহর জায়গা৷  একপাশে একটি পুকুরঘাট অাছে। দিনের বেলায় বাড়িটা বেশ রমরম শব্দে পরিপূর্ণতা পায়।  বাড়ির উঠোন থেকে পুকুরঘাট অবিরাম চলছে ফিসফিস শব্দ৷  ফিসফিস এই শব্দটা একান্তই স্ত্রীবাচকের দখলে।  এতে অামাদের নাক না ডুবানোই ভালো।  অামরাতো চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে গিয়ে, বিস্কুট ও গলে গিয়ে ডুবে যায়।  
রমনীদের চলার শব্দ,  কিশোরিদের নূপুরের ছন্দ, নিশব্দে ফেলে যাওয়া নিঃশ্বাস ক্রমেই জোড়ালো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো বাড়িতে, অার গড়িয়ে পরি অামি। 

দরজার ফুটে দিয়ে দেখি বাইরে কেউ অাছে কিনা?  সেই সকাল ১১টা থেকে দেখি অাসছি কেউ না থাকলেই টুক করে বেরিয়ে গোসল করে অাসব৷  এই বাড়ির সবাই অামাকে বেশ অাপন করে নিয়েছে৷  পুরো বাড়িজুড়েই অামার তোষামোদ চলে।  পুকুরঘাট থেকে রসুইঘর একটাই কথা এই বাড়িতে লজিং অাসছে৷  

অামার বিরুদ্ধে কারোর কোনো অভিযোগ নেই।  গা গমগম করে অাপ্যায়ন চলছে।  
এমনি হঠাৎ খেয়াল করলাম গেইট দিয়ে উর্মি ডুকছে।  অাঙ্গুলের ইশারায় অামি ডাক দিলাম ; 

উর্মি সামনে অাসলো।  অামি বলছি; অনেকক্ষণ ধরেই বেরুতে চেষ্টা করছি গোসল করার জন্য, কিন্তু এতো মেয়ে বাইরে অামার প্রচন্ড ইতস্তত বোধ হচ্ছে। 
উর্মি একটু মুচকি হেসে বলছে, স্যার অাপনি অামার সাথে অাসেন।
অামি এইরকম ভুবন ডাঙ্গার নিঃশব্দ হাসি অাগে কখনো দেখিনি।  শব্দহীন বয়ে যাওয়া উল্লাস এটি।  

যোহরের অাজান হলো৷  অামি নামাজ পড়া শেষ করলাম৷  বিছানায় শুয়ে অাছি, মাথার পাশে রাখা শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর রক্তকরবী৷  এই নন্দিনী কে অামি বড়ো ভালোবাসি৷  অামার প্রিয় ফুল রক্তজবা।  
দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসেছি৷  চাচা রুম মাছের বড় মাথাটা অামার পাতে তুলে দিলেন।  অামি চামচে হাত ঠেকেয়ি না নিতে চাইলাম৷ 

তারপর অান্টি জোর করে পাতে তুলে দিলেন৷  রাফি খাবার নিয়ে নানারকম বায়না করছে।  
উর্মি পাশে বসে খাইয়ে দিচ্ছে।  অামার খুব সুফিয়ার কথা মনে পড়ছে।  অামার অাদুরে বোন৷  কিন্তু কপালপোড়া; জন্ম থেকেই খেটে যাচ্ছে।  কি জানি কতদিন রুই মাছের মাথা খায় না সুফিয়া? 

পড়ন্ত সূর্যের ডুবে যাওয়া,  গোধুলির অবসর। এই সময় পুকুরঘাটটি খালি থাকে।  তাই এটাই উপযুক্ত সময় অামার বসে অবসর কাটানোর৷  অামি এখনো যাদের অাপন ভেবে নিয়েছি তাদের মধ্যে এই পুকুরটিই অন্যতম।  
অাপন মনে নীরব কথাগুলো বলি তার সাথে।  বয়ে যাওয়া কথোপকথ,  কতশত পংক্তিমালা।  

অারফান এর কাছ থেকে শুনেছি এই পুকুরঘাটে নাকি পরীরা অাসে।    পুকুরে নামে, ঘা বিজিয়ে নেয়। 
তবে অামি এখনো এরম অাগন্তুক দৃশ্য দেখিনি।  পরীরা বোধহয় বেশ সুন্দর হয়,  অামার মায়ের মতো। 
অামার মা; গাড় কৃষ্ঞবর্ন,  হরিণের মতো চোখ, কখনো কাজল পড়েনি, দৃষ্টিতে অগ্নির ছোঁয়া, গড়পড়তার এই জীবনে হতাশা, বেদনা, তবু-ও বাচবার লড়াই৷  অামার পরী তবে অামার মা!  

চলবে............                        
                                                        

ফেরা - ২য় পর্ব।



স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাড়িতে প্রবেশ করলাম। কি এক অদ্ভুত মায়া জন্মালো চাচার প্রতি। পেটে ভীষন খিদা লেগেছে। রান্নাঘরের দিকে গেলাম। মা, ছোটমামা, সুফিয়া খেতে বসেছেন।
আমাকে দেখে সুফিয়া বলে উঠল; ভাইয়া তুই বস, আমি তোকে খেতে দিচ্ছি।
আমি গিয়ে বসলাম মামার পাশে।
মামা বলছে; কিরে নামাজ শেষে বাড়ি ফিরতে এতো সময় নিলি?
আমি বললাম; হ্যা, একটু কাজ ছিলো মামা।
সুফিয়া খাবার সামনে এনে দিলেন। ডাল-ভাত দারুন পছন্দ আমার৷ সহজ খাবার। খাবার খেয়ে সবাই উঠে রুমে চলে গেলো। মা বসে আছেন। আমি মনে মনে কৌশল করছি মাকে কি করে চাচার কথাটা বলব।


মা;
হ্যারে বল;
একটা কথা ছিলো।
হ্যা বল না। কিছু কি হইছে বাবা?
ওই যে, রহিম চাচা আছে না, আজ মসজিদে দেখা হলো, কেমন আছি, কবে আসলাম এসব জিঙ্গেস করল;
মা বলল ; ওহ রহিম ভাই। বড়ো ভালো মানুষ রে। তোর আব্বা যখন মারা গেলো কাফনের কাপড় কেনার টাকা ছিলো নাহ আমাদের কাছে। তখন তোর নানাও ছিলো নাহ। খুব বিপাকে ছিলাম। তখনই রহিম ভাই সব বহন করছিলো।
হ্যা মা। মানুষটার মধ্যে অদ্ভুত মুগ্ধতা আছে। আপন করে নেওয়ার ক্ষমতাও বেশ ভালো।
হ্যা রে খোকা; তুই কি বলবি বলছিলি;
শোনো- রহিম চাচা বললো উনার ছেলেমেয়ে কে পড়াতে, সাথে আমিও ওখানে থেকে পড়ব।    
হ্যা রে খোকা.... 
হ্যা মা,  কিছু বলবে?
তো; তুই কি বললি? যাবি? 
দেখো মা, এখানে ছোটো মামার সাথে তুমি আর সুফিয়া থাকো। মামার সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝি। এই অবস্থায় আমার পড়ালেখা চালানো মামার জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠবে৷ তাই ভাবছি রহিম চাচার ওখানে থেকে অামার পড়ালেখা, থাকা-খাওয়ার খরচটা দিব্যি হয়ে যাবে। 
তুই আইজ-ই যাবি বাবা?
হ মা' আইজ বিকাল কইরা রওনা দিমু। 


এই বলে, উঠে আসলাম বাড়ির উঠানে৷ ব্যাগপত্র ঘুছিয়ে নিয়েছি। মা'কে সালাম করে বের হলাম। 
মা ভালো থেকো৷ সুফিয়াকে দেখে রেখো। 
তুই ও ভালো থাকিস বাবা৷  
সুফিয়া ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। আমি কাছে ডেকে চোখ মুছে দিলাম৷ কাঁদিস নাহ পাগলি। ভাইয়া চলে আসবো। 

রহিম চাচার বাড়ির সামনে বিশাল ফটক৷ ফটকের মুখেই দাড়িয়ে আছে তাদের পোষ্য প্রানী৷ কুকুর। কুকুর নাকি খুউব বিস্বস্ত হয়। আচ্ছা মানুষ কি বিস্বস্ত হয় নাহ? 
ফটকের একটু সামনের দিকে আসা মাত্রই কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ শুরু করল। অপরিচিতদের দেখলেই এরা ঘেউঘেউ করতে থাকে। বাড়ির মালিককে হুঁশিয়ার বার্তা দেয়৷ কুকুরের শব্দ পেয়ে রহিম চাচা দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে এলেন। 

অারে রায়হান, বাবা তুমি? আসছো। আসো, আসো। 
জ্বী চাচা; সবে আসলাম। 
চাচা বাাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন। তাদের বিশাল বাড়ি। খোলা উঠান। দক্ষিনে একটা বাগান ও আছে।
 
চাচাদের ড্রয়িংরুমের সোফায় বসলাম। তার মধ্যে উনার দুই ছেলে আসলো। 
চাচা বললেন; এদিকে আসো সালাম দাও। উনি তোমাদের স্যার। আজ থেকে  উনিই তোমাদের পড়াবেন। 
আসসালামুআলাইকুম স্যার....... 
ওয়া আলাইকুম সালাম।  কি নাম তোমাদের? 
জ্বী স্যার, আমার নাম রাফি। আর ওর নাম আরফান৷ 

এরমধ্যেই চা নাস্তা হাতে নিয়ে একজন মাঝবয়সী  আন্টি ডুকলেন। আমার খুব ইতস্ততঃ বোধ হচ্ছিলো। এই প্রথম আমার জন্য কোথাও এতো কদর দেখছি। আমি সালাম দিলাম। 
আন্টি বলল ; বাবা নাও; নাস্তা করো। আর এই বাড়িতে একেবারে নিজের মতো করে থাকবে। তোমার থাকা খাওয়ার অসুবিধে হলে আমাকে বলবে। 
আমি সবেতেই মাথা নাড়িয়ে যাচ্ছি। জ্বী আন্টি। ( আমার গলার স্বরে কথা কেমন যেনো আটকে যাচ্ছিল)

হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম পর্দার আড়াল থেকে কেউ একজন আমাদের কথা শুনছেন। 
চাচা লক্ষ্য করলেন। তারপর; চাচা বললেন; উর্মি মা, আয় এদিকে আয়। 
চাচা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ হলো আমার বড় মেয়ে৷ উর্মি। এইবার সেভেনে উঠেছে। 
উর্মি সালাম দিলো। চাচার ব্যবহারেই বুঝা যায় পরিবার টা খুব মার্জিত এবং বিনয়ী। অাদব কায়দা সবারই জানা। 
আমি ছোটেবেলা থেকেই মার নেউটা ছিলাম। খুউব লাজুক। আমি উর্মির দিকে না থাকিয়েই সালামের জবাব দিলাম। 
সন্ধ্যা নেমে এলো। মাগরিবের আযান হলো। চাচা অার আমি নামাজ পড়তে গেলাম। 

নামাজ শেষ করে, বাড়ি ফেরার পথে আমি মনে মনে ভাবছি উনাদের আস্থার মান রাখতে পারবো কি ' না? 
বাাড়ি ফিরলাম৷ চাচা ওদের পড়ার রুমটা দেখিয়ে দিলো। ওদের পড়ার রুমের টেবিলটা হলো দক্ষিনা বাগানের পাশে। ওখানে অনেক রকম ফুলের সুভাষ৷ পুরো ঘরটা মৌ মৌ করছে। 
এমনি দরজায় ঠক শব্দ। রাফি,  আরফান ঘরে ডুকল৷ আমি বললাম তোমরা বসো। তোমাদের আপু কোথাই? 
রাফি বলল; স্যার আসতেছে। 
রাফি খুব অস্থির স্বভাবের। ওর কথা-বার্তায় তা ক্রমশই প্রকাশ পাচ্ছে। আর আরফান একেবারেই বিপরীত। চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির। 

আমি ওদের পড়ানো শুরু করলাম। কিছু সময় পর, উর্মি আসলো। 
জানালা ঘেঁষে এক বৈরী হাওয়া বয়ে গেলো। 
উর্মি, রাফির পাশের চেয়ারটায় বসল৷ আমি খুব ভয়ে ধীর স্বরে বললাম, দেরি হলো কেনো উর্মি? 
ও চুপ ছিলো।  উত্তর দেয়নি। 
উর্মির এই চুপ থাকার অর্থ মেলাতে পারিনি।  

উর্মি নাজুক বোধহয়। ধবধবে সাদা চামড়া নাহ, শ্যাম-বর্ন, ঠোঁটের এক কোনে একটা তিল আছে। মায়াবী কন্যা। 
পড়ানো শেষ। রাতে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম।  ওদের দক্ষিণা বাগানের দিকে ছোট্ট একটা ঘর৷ 
এই ঘরটাই এখন আমার ঠিকানা৷ এই বাড়িটাই আমার এখন আশ্রয়। 

চলবে..............

ফেরা - ১ম পর্ব।



রাত্তির দুটার নাগাদ৷ হঠাৎ বিছানার পাশে রাখা মোবাইল ফোনটি বেজে উঠল। গভীর ঘুম। ২য়বার আবার বাজলো। চোখ কচলাতে কচলাতে ফোনটি তুললাম। কানে দেয়ার পর, ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম "ভাইয়া মা'র শরীরটা ভালো নাহ। রাত থেইকা খালি তোর কথা কইতেছে। তোরে অনেকবার কল দিছি, তুই ধরস নাই, ভাইয়া এই নে ধর মার সাথে কথা বল।

আমি উঠে বসলাম৷ হঠাৎ করে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনাহ।

হ্যালো মা!
বাবা! তুই কেমন আছিস? বাড়ি আসবি কবে? তোর টাহা পয়সা লাগবো নাহ। তুই বাড়ি চলে আয়। মার লগে থাকবি। ডাইল ভাত খাইয়া বাচুম।
মা! ও- মা! আমি ভালা আছি। তুমার কি হইছে? জ্বর?
নারে বাপ! আমার তোরে দেহোনের অসুখ হইছে৷
মা! দেশের এই পরিস্থিতি। সব লকডাউন। গাড়ি ঘোড়া কিছু চলে নাহ। চাকরীও বন্ধ মা। ক্যামনে যাই৷ আমিও যে ভালা নাই মা! তোমারে সেই কবে দেখছি, তখন কী শীত ছিলো। এহন উত্তপ্ত গরম মা।
তুই ভালা থাক বাপ! সাবধানে থাক।
আমার মনে হলো মা আচল দিয়ে চোখ মুছছে। আমার মায়ের অশ্রুসিক্ত নয়ন।

মা'র নাকি গত দুদিন ধরে শুকনো কাশি। বোনকে জিঙ্গেস করলাম, গলাব্যথা, জ্বর আছে কি না? ও বলল - না ভাইয়া এসব নাই। যাক দুশ্চিন্তা নামল করোনা হয়নাই। ভাই সুযোগ পেলেই চলে আসব। বোনকে বুঝিয়ে ফোনটা রাখলাম।
ওয়াশ রুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিলাম৷ রুমে বাতি জ্বলছে দেখে রুমমেট সজীব একবার উঠল। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ব্যাটা এক ছিচকাদুনির সাথে প্রেম করে। সারারাত ফোনে কথা বলে, আর আফিস গিয়ে ঘুমায়।
সজীব আমার কলিগ। আমি রায়হান। একটা এনজিও তে চাকরি করি। আমার বাবা অল্প বয়সে মারা যায়।

সংসার বলতে আমি, মা আর বোন সুফিয়া। বাবার চলে যাওয়ার পর থেকে সংসার এর হাল বইতে হলো আমাকেই। মামার বাড়ি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। তারপর আর মামার ও সামার্থ্য ছিলোনা পড়ানোর। আসলে কথায় আছে নাহ "অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়" আমার হলো ওই দশা।

ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে রওনা হলাম, লক্ষীপুর। মায়ের কাছে। মা আর সুফিয়া থাকে লক্ষীপুর নানার বাড়িতে। তাদেরও অভাবের সংসার। ছোট মামা সংসার চালায়৷ দিন আনে দিন খায়, এমন করেই চলছিলো। এখন নতুন করে গিয়ে জুটলাম আমি। ভাবছি কি করা যায়।

সবে এইট পাশ করলাম, কিছু করতে চাওয়া মানে লেখাপড়া টা ছেড়ে দেয়া। কিন্তু লেখাপড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন বুনছি প্রতিদিন, অন্যদিকে এই অভাব চোখে সইছে নাহ।
দিন যাচ্ছে, সংসারে খরচ - ও বাড়ছে৷ মা-ও অভাবের তাড়নায় ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

একদিন জুমা বার। মসজিদে নামাজ আদায় করতে গেলাম। নামাজ শেষে বসে আছি। তাসবিহ পড়ছিলাম আপন মনে। এমনি পাড়ার একজন চাচা এসে পাশে বসল। আমি সালাম দিলাম। উনি বলল, বাবা কেমন আছো? মামার বাড়ি থেইকা আসলা কবে ? অামি বললাম এইতো চাচা কয়েকদিন হলো।

চাচা বলেন, তো বাবা এহন কি করো?
ক্লাস এইট পাশ করে নাইনে উঠছি। এহন এখানে স্কুলে ভর্তি হমু৷ কিন্তু টাহা পয়সা নাই ক্যামনে যে কি করমু চাচা!
চাচা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, তো বাবা তুমি অংক ক্যামন বুঝো?
আমি বললাম, বুঝি চাচা, মানানসই।
চাচা বলেন; তুমি এক কাম করো আমার বাড়িতে লজিং থাকো। আমার দুইডা পোলা আছে, ফাইভে পড়ে, আর একটা মাইয়া আছে ক্লাস সেভেন এইবার।
তুমি ওদেরকে পড়াবা, সাথে নিজেও পড়বা। তোমার লেখাপড়ার খরচ আমিই চালামু।

আমি চাচার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। মনে হলো ঈশ্বরের পাঠানো কোনো দূত কথা বলছেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বললাম ঠিক আছে চাচা; আমি আইজ সন্ধ্যায় আপনাকে জানামু। এহন তাইলে আসি। আসসালামুআলাইকুম....

বই: বাংলা সাহিত্যে গাউসে পাক প্রসঙ্গ। লেখক: মোহাম্মদ আবু সাঈদ।

কে গাউছে পাক? 
কে মুহিউদ্দীন?
কে সুলতানুল আউলিয়া?
কে গাউছুল আযম?

এই প্রশ্নের উত্তর জানে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য দুষ্কর।  

তিনি হলেন হযরত শাইখ আব্দুল কাদির আল-জিলানী আল-হাসানী ওয়াল-হুসাইনী। 
সংকলনকারীর সাথে একমত পোষণ করে বলতে পারি 'তাসাউফ নিয়ে পড়াশোনা করছেন বা সুফিজম নিয়ে ধারণা রাখেন, তারা ছাড়াও সাধারণ মুসলমানদের কাছেও গাউসুল আযম পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ। 

হযরত গাউছুল আযম কেবলমাত্র একজন শীর্ষস্থানীয় সুফিসাধকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে আইনজ্ঞ, শাস্ত্রবিধ, ধর্মবেত্তা, দার্শনিক অসাধারণ বাগ্মী ও সুসাহিত্যিক। 




"বাংলা সাহিত্যে গাউছে পাক প্রসঙ্গ" তরুণ গবেষক মোহাম্মদ আবু সাঈদের দ্বিতীয় সংকলন এটি। আমরা জানি জলের তলায় ডুব দিয়ে যারা কাজ করে তাদের ডুবুরী বলা হয়। 
সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনুক আর নাইবা আনুক একজন ডুবুরী কি পরিমাণ কষ্ট করে এবং কি পরিমাণ আত্মত্যাগ করে সেটা প্রত্যক্ষ সাক্ষী না হলে হয়তো বিশ্বাস করা যাবে না। এই কথাগুলো একজন গবেষকের জন্যও বিবেচ্য বলে বোধ করি। 
বইটির প্রতিটি পাতা স্পর্শ করলে বুঝতে পারবেন এখানে গবেষক মোটোমুটি ডুবুরী হিসেবেই জলে নেমেছেন। তবে সিন্ধু সেঁচে কতটুকু মুক্তা কুড়িয়ে আনতে পেরেছেন সেটা একজন বিচক্ষণ পাঠকই উত্তর দিতে পারবেন।  

একজন পাঠকের কাছে বইয়ের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।  ভূমিকাটি গোটা বইয়ের একটি প্রতিচ্ছবি। বেশ সময় নিয়ে পড়েছি। যা মনে হলো মোটাদাগে কয়েকটা বিষয় তুলে আনতে চেয়েছেন গবেষক। কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন যা একটা "গ্রুপ অফ মেস্বার" দের জন্য তোজোদীপ্ত মেসেজ হতে পারে। 

যেমন-
. বাংলায় আদর্শবান ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তি হিসেবে গাউছে পাকের চর্চা হয়েছে খুব কম। 

.  চর্চা যাই হয়েছে সেটিও ভক্তিবাদে পর্যবসিত,  আর্দশ নিয়ে কোনো কাজ নেই। 

. সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গাউসে পাককে পাঠ করা। 

. এক জুলুমবিরোধী গাউছে পাক। 

ভুমিকাটি পড়তে গিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ল। 
কোথাও একটা পড়েছিলাম ঘটনাটির সূত্র মনে নেই। 
নব্বই দশকের শেষের দিকে, শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের যােগ্য উত্তরসূরী জনাব আব্বাসী কোনো এক সেমিনারে সঙ্গীত তাসাউফের বিষয়ে কিছু বলছিলেন। বলতে বলতে বলেন, তােমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো তাদের উচিৎ আমাদের সূফিসাধকদের মূল্যায়ন করা। আমি ইরাকে গিয়ে এক টেক্সি ড্রাইভারকে, হজরত আব্দুল কাদের জিলানীর মাজারে নিয়ে যেতে বললাম, সে তা চিনে না বলে উত্তর দিলো। আমি নাছােড় বান্দা হয়ে এক বয়স্ক ড্রাইভারের কাছে যাই এবং তাকে জিঙ্গেস করি, তখন ঐ বৃদ্ধ ড্রাইভার বলেন -গিলানি গিলানি হাঁ চিন্তে পেরেছি। আমাদের যুব সমাজ গিলানিকে ভুলার কারণেই আজকে তাদের অধঃপতন হয়েছে। জনাব আব্বাসী বলেন 'হীনমন্যতার কোন বালাই নেই, আমিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সূফীদের সাথে সম্পর্কের কারণে আমার কোথাও মর্যাদার কমতি হয়নি বরং বেড়েছে'।  

আজকে ছাত্রদের মধ্যে 'আর্দশিক গাউসে পাক' এর চর্চা নেই। তাঁর রুহানিয়াত বিশেষ ব্যক্তিত্ব নিয়ে যত গুনগান, প্রশস্তি হয়, তার ছিটেফোঁটাও 'একজন আদর্শবাদ মানুষ' হিসেবে হয়না। 

জুলুম, সহিংসতাপূর্ণ দুনিয়ার বিরুদ্ধে মজলুমদের যে লড়াই কি হতে পারে তার ইশারা কি গাউসে পাক দেন নাই?  
বর্তমানে জুলমভরা পৃথিবী ও সহিংসতাপূর্ণ সমাজে একজন মজলুমের আইডল কি গাউসে পাক হতে পারে না? 
এইসব জানাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজে, স্কুলে। মাঠে-ময়দানে। তুলে ধরতে হবে বই পুস্তকে।

যুগ এবং সময় কোন গাউসে পাককে চাইছে, সেই গাউসে পাককে আবিষ্কার করতে হবে। তবেই চর্চার ফল ভোগ করা সম্ভব।

আধুনিক যুগের কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হক, ফররুখরা কই?  যাদের হাত দিয়ে গাউছে পাক প্রবাহিত হবেন। 

বাংলা সাহিত্যর আধুনিক যুগে গাউসে পাককে নিয়ে খুব বেশি লেখা হয়নি তা স্পষ্ট। আর গবেষক বাংলা সাহিত্যে গাউছে পাকের চর্চাকে মুখ্য বিষয় করেই বইটি লিখেছেন। তাও সুস্পষ্ট। শুরুটা আলাওল দিয়ে হলেও হায়াত মামুদ, কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হক, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ফররুখ আহমদ, রকীব শাহ, সুফিয়া কামাল, সাবির আহমেদ চৌধুরী,  মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ, আলাউদ্দিন আহমেদদের গাউসে পাক নিয়ে বিচরণ ছিলো অভাবনীয়।

পুরো বইটি পড়ার পর, আমি একজন পাঠক হিসেবে বলতে পারি, কায়কোবাদ, মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এবং মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ উনারদেরকে সাথে নিয়ে গাউসে পাককে জানার প্রবল ইচ্ছা আপনার মধ্যে সৃষ্টি হবে, হবেই। ক্রমানুযায়ী সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ; 

. কায়কোবাদ : 
উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলমানের প্রধান পুরুষদের অন্যতম কবি কায়কোবাদ। তিনি সুফিমনাই ছিলেন ; জীবনের আয়ুষ্কাল শেষদিকে পীরের আদেশ আসে গাউছের রচনা নিয়ে কাজ করার। কায়কোবাদ অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে নাকচ হোন কিন্তু পীর বলেন- 'গাউছুল আযমের এই রচনাকার্য শেষ না হওয়া অবধি তোমার আয়ুষ্কাল শেষ হবে না'
পীরের আদেশে শুরু হলো নতুন যাত্রা। কি অসহনীয় পরিশ্রম করে গাউছে পাকের জীবনী রচনা করেছেন তা বুঝানো মুশকিল। 'ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি,  অসুস্থ দেহ, নিস্তেজ প্রাণ' এই নিয়েই শেষ করেন গাউছের জীবনী রচনা। গাউছে পাকের কাব্যজীবনী রচনা করার দায়িত্ব কবির অন্তিমলগ্নে জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে এবং  তাঁর প্রতি কি গভীর প্রেম পুরো পাঠেই আন্দাজ করতে পারবেন। 

.মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ: 
পুরো বইটিতে সবকজনের মধ্যে তাঁকে একজন 'জাত গবেষক' হিসেবে মনে হলো ।  তিনি গাউছে পাককে নিয়ে সংক্ষিপ্ত জীবনী রচনা করেছেন কিন্তু তথ্য দিয়ে মুড়ানো ছিলো তার গবেষণা।  নজরকাড়বে সুনির্দিষ্ট তারিখ। বুঝা যায় মুহাম্মদ  শহিদুল্লাহ কতখানি গভীর চর্চায় মাতোয়ারা হয়েছিলেন। আর গবেষক তা খুব যত্নের সাথে উদ্ধার করেছেন। 

. মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ: 
আমার মতে পাঠক হিসেবে তাঁকে নিয়ে আফসোস এর শেষ নেই। কালগর্ভে হারিয়ে যাওয়া একজন। সঠিকভাবে পাঠকের দ্বারে কদর পাননি তিনি।  গাউছে পাককে নিয়ে তাঁর ' জীলান সূর্যের হাতছানি ' পড়লে বুঝতে পারবেন কি ছিলো তার কোমল উপস্থাপন, আর কত রুপময় ছিলো তার বলার ভঙ্গীমা। তবে আমাদের গবেষক মোহাম্মদ আবু সাঈদের মাধ্যমে জানতে পারবেন মোহাম্মদ মামুনুর রশীদের চর্চার সার-সংক্ষেপ।  
গাউছে পাকের দেহাবয়ব বর্ননা এতো শিল্পের মিশ্রনে পূর্বে কেউ করছে কি না আমার জানা নেই। 
তিনি লিখেন: "হজরত বড়পীর র. ছিলেন সৌম্যকান্তি সুদর্শন পুরুষ।  তাঁর শরীরের রং ছিলো উজ্জ্বল।  মধ্যমাকৃতির ছিলেন তিনি। বক্ষ ছিলাে প্রশস্ত। শরীর কৃশকায় হলেও তাঁর সমস্ত অবয়বে ছিল প্রখর ব্যক্তিত্ব্যঞ্জক অভিব্যক্তি। কণ্ঠস্বর গম্ভীর, সুস্পষ্ট ও সুমধুর। প্রশান্ত ললাট। ক্ষীণ ভ্রুরেখা সংলগ্ন। দাঁড়ি মােবারক অত্যন্ত ঘন।
স্বভাব গাম্ভীর্যমণ্ডিত। নীরবতা ও নির্জনতা ভালবাসতেন তিনি।”
কি চমৎকার বিশ্লেষণ। সাত-সমুদ্র তেরো নদী ভ্রমণে যে সুখ পাওয়া যায় তা হয়তো গাউছে পাক নিয়ে লেখা মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ এর উক্তিগুলোতে পাবেন। পুরো অংশটাই উজাড় করা হাওয়ার মতো মনে হবে। 

সাথে রয়েছে কাসিদায়ে গাউসিয়া: বাংলায় কাব্যানুবাদ। 

আমার মতে একজন 'গাউছে পাক' পাঠকের জন্য গোটা বইটাই সারপ্রাইজ। গবেষককে নিয়ে  সমালোচনা করার জায়গাটার ফ্লোর নেই। কারণ, শূন্যস্থানগুলো কেবল পূরণ হচ্ছে, তাকে সাধুবাদ জানানোটাই উত্তম বলে বোধ করি। আমি বিশ্বাস করি, গাউছে পাকের বিচরণ হাজার হাজার কেতাবে লিখলেও পাঠকের তৃপ্তি মজবে না, গবেষকের ও কালি ফুরাবে না। তবে মোহাম্মাদ আবু সাঈদ আপ্রাণ চেষ্টা করেছে "বাংলায় গাউছে পাক নিয়ে চর্চার সার-সংক্ষেপ" তুলে আনতে। গবেষকের চেষ্টাটা ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনার মতোই। আমার মনে হয় আমাদের পাঠক সমাজ এই বিষয়ে মহৎ একটি ধারণা পাবে। পূর্বে, যা অন্তরচক্ষু দূরে থাক চর্মচক্ষুতেও ধরা পরে নি সেইসবও ধরা পড়বে।  

"বাংলা সাহিত্যে গাউছে পাক প্রসঙ্গ" বইটির সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ। নিশ্চিতভাবে এই সৃষ্টি পাঠকসমাজে কড়া নাড়বে।

সিরাজুল উম্মাহ

ইংরেজিতে একটি কথা প্রচলিত আছে ‘Behind every successful man there is a woman’
এই কথাটি পরীক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ইতিহাসে এমনও একজন আছেন, যিনি তাঁর জীবনের সফলতার জন্য তিনজনকে সর্বদা স্মরণ রেখেছেন। প্রথম মহিলা তাঁকে ধোকা দিয়ে শিক্ষা দিয়েছে, দ্বিতীয় মহিলা ফিক্বহ শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং তৃতীয় মহিলা সারারাত জাগরণ করে ইবাদতে উৎসাহিত করেছেন।

প্রথম মহিলা সমন্ধে এই মনীষী বলেন, “একদিন এক মহিলাকে দেখলাম রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চোখের ইশারায় কি যেন বলছিল। আমি মনে করলাম সে হয়তো বোবা। এগিয়ে গেলাম তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু সে আমাকে রাস্তার একটি বস্তুর দিকে ইঙ্গিত করছিল। ইশারায় সে বুঝাতে চেয়েছিল যে, তার কোন জিনিস পড়ে গিয়েছে, আমি যেন তাকে তা তুলে এনে দিই। আমিও তা তুলে এনে তার সামনে ধরলাম। আমি যখনই তাকে দিতে গেলাম সেই মহিলাটি বলে বসল, “এটা আপনি রাখুন। এটার মালিক এসে আপনার নিকট থেকে নিয়ে যাবে।” বস্তুতঃ সেটা ছিল লুক্বতাহ্' (কুঁড়িয়ে পাওয়া বস্তু)। (গাউসিয়া তরবিয়াতী নেসাব,পৃষ্ঠা-৬৩০)
দ্বিতীয় মহিলার ব্যাপারে তিনি বলেন, “একবার আমি ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পাঠদান করছিলাম। আমাদের মজলিস ছিল বিশিষ্ট ফকিহ হাম্মাদ ইবনু সুলাইমানের মজলিসের কাছাকাছি। এ সময় এক মহিলা এসে জিজ্ঞাস করলেন, যদি কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে সুন্নাহ পদ্ধতিতে তালাক দিতে চায়, তবে কীভাবে দিবে? আমি বললাম, “আপনি এই মাসআলাটি ইমাম হাম্মাদকে জিজ্ঞাস করুন। তিনি উত্তর দিলে দয়া করে আমাকেও জানাবেন। 

মহিলাটা ঠিক ঠিক হাম্মাদ থেকে মাসআলা জেনে আমাকে বলল, হাম্মাদ বললেন, “তালাকের সুন্নাহ পদ্ধতি হচ্ছে, স্বামী তার স্ত্রীকে সঙ্গম ও ঋতুস্রাব অতিবাহিত করবে। তিন ঋতুস্রাব অন্তর্বতী সময়ে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে। তৃতীয় ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হওয়ার পর তাদের পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটবে এবং স্ত্রী অন্যন্ত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি পাবে।”
মহিলা থেকে এই জবাব শুনে আমি বললাম, “ধর্মতত্ত্ব বাদ দিয়ে এইবার আমাকে ফিকহের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এই বলে আমি তাৎক্ষণাৎ জুতো জোড়া সঙ্গে করে ইমাম হাম্মাদের নিকট উপস্থিত হলাম। প্রতিদিন খুব মনোযোগ-সহকারে তার দরস শুনতাম। দরস শেষে ভালোভাবে সেটা রপ্ত করে নিতাম।”(আল খাইরাতুল হিসান, ইবনে হাজার হাইতামি, পৃষ্ঠা-২৫)
তৃতীয় মহিলার ব্যাপারে তিনি বলেন, “একদিন এক নারী আমার দিকে ইঙ্গিত করে তার সঙ্গীনীদেরকে বলছিল, “ইনি হলেন এমন ইবাদত পরায়ণ ব্যক্তি, যিনি সারারাত আল্লাহর ইবাদত করেন।” এই কথাশুনে আমি হতচকিয়ে গেলাম। কেননা, এই কথা সম্পূর্ণ সত্য না। অথচ, আমি তখনো রাতের একটা অংশ ঘুমাতাম। তখন থেকে আমি ভাবলাম আমাকে সারারাত জাগতে হবে, যাতে মুসলমানদের ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়।” শ্রুত আছে যে, দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ এশার নামাযের ওযু দিয়ে ফজরের নামায সস্পন্ন করেছেন। 
তাঁর রাত জেগে ইবাদত সমন্ধে মিসআর ইবনু কিদাম বলেন, একদিন আমি দেখি যে তিনি ফজরের পর থেকে যোহর পর্যন্ত টানা দরস দান করেন। যোহরের এবং মাগরিবের পর থেকে যথারীতি ইশা পর্যন্ত। এভাবে সারা দিন। আমি মনে মনে ভাবি, এই লোকটা যদি সারা দিন এভাবে দরস দানে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে ইবাদত করেন কখন? আজ আমাকে তাঁর ইবাদতের অবস্থা দেখতেই হবে। 
পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি তাঁর সম্পূর্ণ অগোচরে থেকে তাকে লক্ষ্য করতে থাকি। এশার সালাতের পর সবাই ঘরে ফিরে গেলে, তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন। মসজিদ তার ঘরের পাশেই ছিল। তিনিই এ মসজিদে ইমামতি করতেন। রাতে সালাত আদায়ের জন্য তাঁর বিশেষ পোশাক ছিল। সেটা পরিধান করে মসজিদে প্রবেশের পর সোজা সালাতে দাঁড়িয়ে যান। এভাবে ফজর পর্যন্ত সালাত আদায় করতে থাকেন। অতঃপর ঘরে প্রবেশ করে পোশাক পরিবর্তন করেন। ফজরের পর সেই আগের মতোই চলতে থাকে। আমিও তাকে প্রতিদিন লক্ষ্য করতে থাকি এবং বরাবরের মতোই তাঁকে দিনে সাওম পালন, দরস প্রদান এবং রাতে সালাত ও তিলাওয়াতে নিমগ্ন থাকতে দেখি। কখনো এর ব্যতিক্রম হতে দেখিনি। অবশ্য ক্লান্তি দূর করার জন্য শুধু যোহরের আগে সামান্য বিশ্রামে যেতেন। (ইশারাতুল মারাম মিন ইবারাতিল ইমাম, কাজি কামালুদ্দিন বায়াযি, পৃষ্ঠা-১৫।)

উপর্যুক্ত ঘটনাটগুলো আমাদের পরিচিত না হলেও, যাঁর সাথে এইসব ঘটেছিল তিনি আমাদের অতি পরিচিত এবং যুগে যুগে প্রত্যেকের জন্য তিনি ছিলেন আলো। যে আলো দিয়ে কেউ তার ঘর আলোকিত করেছে, কেউ খুঁজে পেয়েছে সহজ-সরল পথ। মহান প্রভুর ভাষায় ‘সিরাতাল মুস্তাকিম’। এই আলো আর কেউ নন, জ্ঞানীরা যাঁকে এক বাক্যে ডেকে থাকেন ‘সিরাজুল উম্মাহ(উম্মতের প্রদীপ)’। আর আমাদের মতো সাধারণরা তাকে ডাকে ‘ইমামে আজম’। হ্যাঁ, তিনিই হলেন, হজরত নুমান ইবনে সাবিত। আবু হানিফা উপনামেই যিনি সর্বাধিক খ্যাত। কেনই বা তাঁর এই সকল গুণাবলী থাকবে না, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ায়সাল্লাম যে বলেছেন, “যদি ইলম সুরাইয়া নক্ষত্রের সমপরিমাণ উচ্চতায় পৌছে যায়, তবে পারস্যের যুবকদের অন্যতম এক যুবক সেখানেও পৌঁছে যাবে (অর্থাৎ ওই জ্ঞান সেখান থেকে আহরণ করে নিয়ে আসবে)।” হাদিসে পাকটি হজরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বর্ণনা করেন। হজরত আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রাহমাতুল্লাহি  আলায়হি আবু নুআয়মের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘হুলিয়া’তে এটি উল্লেখ করেন। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,  ইমাম সুয়ুতী বলেছেন যে, এ হাদিস শরিফে হুযূর সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যেই মহান ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি হলেন, ইমামে আজম হজরত আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। অনুরূপ সায়্যিদুনা হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “আমি তোমাদেরকে কুফা নগরীর এমন এক ব্যক্তির কথা বলছি, যার উপনাম হবে আবু হানিফা, তাঁর হৃদয় হবে ইলম ও হিকমতের সমুদ্র, তাঁর কারণে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু কিছু লোক তাঁর প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করবে।”
জীবনের প্রথম ইমামে আজম ছিলেন ইলমে কালামের একজন দক্ষ ব্যক্তি। ভাষার দক্ষতায় নাস্তিকদের কুপকাত করতে  তাঁর কোনো জুরি ছিল না। একবার এক নাস্তিক ইমামে আজম থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার খোদা কোথায় থাকে?” ইমামে আজম বললেন, “তুমি এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসো।” নাস্তিক দৌঁড়ে গেল, দুধ নিয়ে ফেরত আসলো। ইমামে আজম বললেন-
-বল এর মধ্যে মাখন কোথায় থাকে?
-সব খানে।
-যদি মাখনের মত সৃষ্ট বস্তু দুধের সব জায়গায় থাকে তাহলে আল্লাহ কিভাবে একটি স্থা্নে থাকতে পারে? এটা তো বিরট আশ্চর্য!
আরেকদিন আরেক নাস্তিক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার খোদা কোন দিকে মুখ করে আছেন?”
ইমামে আজম বললেন- যদি কোনো অন্ধকার স্থানে মোমবাতি আনা হয় সেটা কোন দিকে মুখ করে থাকে?
- সব দিকে
- যদি তোমার পার্থিব কৃত্রিম আলো সব দিকে মুখ করে থাকতে পারে, তাহলে যিনি আলো তৈরী করেছেন তিনি কি পারেন না?

আহা! কি জবাব। কি চিত্র। কঠিন থেকে কঠিনতম সমস্যাও হয়ে যায় জলের মতো স্পষ্ট। মাত্র দুটি উল্লেখ করলাম। তার এমন জবাব অগণিত।  মঞ্চে বসার পূর্বে আমাদের অবশ্যই বিচক্ষণ হতে হবে। ইমামে আজম দৃঢ়তার সাথে কথা বলতেন। তার প্রতিটি কথা হতো যুক্তিনির্ভর। 
বাগ্মী ও সুতার্কিক হওয়া সত্ত্বেও ইলমে ফিকাহ-রত প্রেমে পড়ে তিনি যুক্তিবিদ্যাকে চিরতরে বিদায় জানিয়ে দিয়েছিলেন। মানাকিবে ইমামে আজম কিতাবে উল্লেখ আছে, “ইমামে আ'যম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সর্বপ্রথম ইলমে কালাম(তর্ক শাস্ত্র বা যুক্তিবিদ্যা) শিক্ষা আরম্ভ করেন। এই বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জনের পর বিভিন্ন বাতিল ফির্কার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতেন। কিছু দিন এভাবে অতিক্রম হওয়ার পর তিনি চিন্তা করলেন যে,  সাহাবায়ে কিরাম দ্বীনি বিষয়ে সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা আল্লাহ’র সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে জবরীয়া ও কদরীয়া ইত্যাদি বাতিল ফির্কাদের সাথে বিতর্কে জড়াননি। বরং, এর বিপরীতে শরয়ী ও ফিকহী মাসআলা'র দিকে তাঁদের মনোযোগ ছিল বেশি। আর, ইলমে কালাম যদি এতই গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে তাঁরাতো কখনো তা পরিত্যাগ করতেন না৷ এই খেয়াল মনে জাগ্রত হওয়ার পর তিনি ইলমে কালাম পরিত্যেগ করে ইলমে হাদিস ও ইলমে ফিকাহের প্রতি মনোনিবেশ করলেন( মানাকিবে ইমামে আজম, খণ্ড-১, ইমাম মুয়াফফিক ইবনে আহমদ মক্কী রাহিমাহুমুল্লাহ, পৃষ্ঠা- ৫৯) 
(শরহে মুসনাদে ইমাম আ’যম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু, হাফেয মওলানা মুহাম্মদ ওসমান গণি, পৃষ্ঠা-১৮।)
গবেষকদের মতে তিনি চল্লিশ হাজার হাদিস থেকে বাছাই করে ‘কিতাবুল আসার’ সংকলন করেছিলেন। তার সবচেয়ে বড় অবদান হলো কোরআন ও হাদিস থেকে জনসাধারণের আমল উপযোগী মাসআলা বের করার মূলনীতি দাঁড় করানো। তার সম্পাদিত এ শাস্ত্রের নাম উসুলুল ফিকহ। এ কাজের জন্যই তিনি ইমামে আজম খ্যাতি লাভ করেন। তার প্রণীত ‘ফিকহ’ আমাদের কাছে ফিকহে হানাফি নামে পরিচিত। তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপ উম্মতে মুহাম্মদির জন্য শিক্ষা। জ্ঞানার্জনের অহর্নিশ  ছুটেছেন সর্বত্র। জ্ঞান ধাপগুলোতে রাজত্ব নিয়ে বসে পড়েছিলেন ইলমে তাসাউফের দরসে। যেখানে তিনি সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, ইমাম জাফর আস-সাদিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র। যাঁর দুই বছরের সান্নিধ্যকেই তিনি জীবনের আসল বছর বলে গণনা করতেন। তাঁর যুগে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। জ্ঞানে, ইবাদতে কিংবা মিথ্যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে। সত্যের রাস্তায় সদা অবিচল এই ইমামের শেষ যাত্রা দুনিয়াবি দৃষ্টিতে অতটা সুন্দর কিংবা আড়ম্বর হয়নি। সাইয়্যিদুনা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথা-ই এখানে প্রমাণিত হয়েছে। জালিম বাদশাহর পক্ষে না থাকায় তাঁকে শহিদ করা হয়েছিল নির্মমভাবে। দুনিয়ার চোখে এটি মর্মান্তিক ও ভয়ানক হলেও মুসলিমরাতো জানে শাহাদাতের স্তর কেমন! কতটা তার মর্যাদা! আর ইমামে আজম তো ছিলেন প্রেমিক। আল্লাহর প্রেমের এক অনন্য প্রেমিক। আর মৃত্যু তো সেই প্রভুর মিলনের একমাত্র সেতু। আবার তাও শহিদি মৃত্যু। এইসব জানতেন ইমামে আজমও। তাই আর কী, চলে গেলেন যেভাবে সবাইকে চলে যেতে হয়। চলে গেলেন একটি যুগে বসে পরবর্তী হাজার যুগে রাজত্ব করা এই মহান মনীষী। তবে রেখে গিয়েছেন, তাঁর আদর্শ শিক্ষা এবং জ্ঞান। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইমামে আজমের মর্যাদা বুঝার এবং সমুন্নত রাখার তৌফিক দান করুন। আমিন।

আদু ভাই।




কিছু এপিটাফ নিঃসন্দেহে আপনাকে কাঁদাবে। প্রায়শই আমি গুগলে সার্চ করি "Epitaph picture"। কতশত লাইন চোখের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেইসব লাইনের গল্পগুলো আমরা জানতে পারি না; কেবল ছন্দগুলোই পড়ি আর ভিতরে ভিতরে গল্পের প্লট সাজাই।

ঠিক তেমনই একটি এপিটাফ আদু মিয়ার। যার গল্পটা আমাদের জানা, তাই যন্ত্রণাটার বেশ গভীরে স্পর্শ করতে পারি।

বলছিলাম আদু ভাইয়ের কথা। মনে পড়ে ক্লাসের বারবার ফেলটুস ছেলেটাকে কত হাসির ছলে আদু ভাই, আদু ভাই বলে ডাকতেন? এই আদু ভাই গুলা একেকটা ধৈর্যর পাহাড়।

‘আদু ভাই’ আবুল মনসুরের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গল্প। এ গল্পে সমন্বয় ঘটেছে হাস্য ও করুণ রসের। কোনো মহলকে খোঁচা দেওয়া বা আক্রমণ নয়, একান্তই নির্মল হাস্যরস সৃজন এ গল্পের মূল উদ্দেশ্য। আদু ভাইয়ের নির্মম পরিণতি গভীরভাবে সিক্ত করেছে, কি স্নিগ্ধ করুণ হাস্যরস।

ক্লাস সেভেন পাশ করতে করতে আদু ভাই তরুন থেকে যুবক হলেন; সময়ের নিয়মে বুড়ো হলেন।
হাল ছাড়েননি তবুও। শেষসময়ে দিনরাত পরিশ্রমে কাহিল হয়ে পড়লেন। এইবার পাশ করতেই হবে। ডো অর ডাই। দিনরাত পড়াশোনা, বৃদ্ধবয়সে শরীর যে মানে না। অসুস্থ আদু ভাই বিছানায় শুয়েই পরীক্ষা দিলেন। আদু ভাই পাশ করল।
আদু ভাই ছেলেকে নির্দেশ দিলো আমার জন্য "প্রমোশনের উৎসব" আয়োজন কর। আদু ভাই নিজ হাতে দাওয়াতনামা লিখলেন। বিধাতার কি চমক! আদু ভাইয়ের প্রমোশনের উৎসবেই হলো, আদু ভাইয়ের জানাযার আয়োজন।

রবীন্দ্রনাথের সুলেখা কালি।

একটা গল্প বলি। রবীন্দ্রনাথের। গল্পটা কালি প্রসঙ্গে।



একবার 'সুলেখা' নামের একটি কালির কোম্পানি প্রচারণার জন্য বিজ্ঞাপন বানাবে বলে ঠিক করে। এখন কালি প্রসঙ্গে বিজ্ঞাপন কে লিখে দিবে? হাত পাতা হলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।

কবি লিখলেন,
"সুলেখা কালি।
এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।"

অদ্ভুত সুন্দর বিজ্ঞাপন না? মাত্র এই কটি কথা। শব্দ সংখ্যা পাঁচ। বিজ্ঞাপনের ভাষা এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত,আকর্ষণীয়, বুদ্ধিদীপ্ত আর কি হতে পারে। রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাংলায় বিজ্ঞাপনের ভাষা তৈরি করেছিলেন। তার ভাষা কতটা সংক্ষিপ্ত আর অর্থবহ হতে পারে তাও তিনিই শিখিয়েছিলেন। আজও সেই ধারা অব্যাহত আছে। শুধু নেই সেই কালি। যে কালির বিজ্ঞাপনের মডেল ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

নোট: ছবিটি অনলাইন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া।
সামাজিকভাবে আমরা প্রত্যেকে একরকম হতে চাই। দেখতে এক, খেতে এক, কাজে এক, পরনে এক, ভাবনায় এক। খুব সম্ভবত, ইংরেজিতে এটাকে মিডিওক্রিটি(averageness)বলে। সবাইকে এক হতেই হবে এমন একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে আমরা বেড়ে উঠছি। একটা প্রজন্মকে ল্যাংড়া বানিয়ে বসিয়ে রাখার জন্য সুশীল সমাজের বস্তুত এই ট্রিকস টাই যথেষ্ট। তবে ভিন্নতা তো থাকেই। সৃষ্টির শুরু থেকেই আছে। কিন্ত সেটার প্রসেসিং টু কন্টিনিউয় করা অনেক চ্যালেঞ্জিং।  শুরু থেকেই ভিন্ন হওয়াটাকে আমরা অস্বাভাবিক চোখে দেখি। 

যেমন সমাজের বিত্তবানরা, গরীব-অসহায়দের সাহায্য করবে এটা খুব সিম্পল ব্যাপার, স্বাভাবিক থিওরি, বাট এই বিষয়টাকে আমরা টেনে অস্বাভাবিক বানিয়ে ফেলি। অবাক দৃষ্টিতে দেখি। ঠিক একইভাবে ভিন্ন হওয়ার বিষয়টি আমরা অস্বাভাবিক চোখে দেখি, স্বাভাবিকভাবে নিতেই পারিনা।  

কিন্তু আমার মনে হয়; সৃষ্টির প্রতিটি সত্তাই আলাদা, ভিন্ন। ভাবনা ভিন্ন, কর্ম ভিন্ন, দেখতে ভিন্ন, এমনকি খোদার নিকট ইবাদতের ধরনটাও ভিন্ন, সব ভিন্ন। ঝামেলাটা শুরু হয় তখন থেকেই যখন সে ভিন্নভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে। 
তখন ওই ভিন্ন হওয়া লোকটা সুশীল সমাজের ৮০ শতাংশের চোখে অসামাজিক, ক্ষেত, ম্যানারলেস, আর পাতি ভাষায় বেয়াদব, উগ্র।  স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এই চর্চা আমাদের ঘরে ঘরেই চলে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই ভিন্ন হয়ে জন্মানোর পিছনে নিশ্চয়ই তাঁর কোনো না কোনো পরিকল্পনা রয়েছে, কারন রয়েছে। ভিন্নটা ভাবাতে হয়তো একটা ফরসা আলো আসতে পারে। আলো ফিরিয়ে আনার সেই সুযোগটা না পেয়ে বহু কামেল  মঞ্চ ত্যাগ করে মুখ লুকিয়ে  বসবাস করছে এমন নজিরও বর্তমানে অহরহ।
ফজরের আযানে অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধতা পাই। গোটা পৃথিবীতে মুয়াজ্জিন তাঁর কায়দায় মুগ্ধতা ছড়ায়। কোমল আহ্বান আর আজানের সুমধুর ধ্বনি। দিনের শুরুটাই যদি হয় এমন সেলিব্রেশন দিয়ে, আর কি চাই আমাদের। 

ভাবি, দুনিয়াতে মুয়াজ্জিনের মতো এতো দরদ নিয়ে আর কে ডাকে আমাদের। আহ! কি যত্ন নিয়ে জাগিয়ে তুলেন। কন্ঠে সবটুকু আল্লাদ ঢেলে দেন। বলেন; 
"আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম"  
"আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম" 

কি প্রফুল্ল সুর আর কি প্রফুল্ল তাঁর বানী!
ফজরের সময়, মুয়াজ্জিনের আযানে আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়। প্রাণে চাঞ্চল্য আসে। দিনের শক্তি জোগান দেই। 
খোদা, পাপ-পঙ্কিলতার জীবন ছেড়ে আপনার আনুগত্যের পথে যেনো ধাবিত হই। ক্ববুল করুন আমাদের। ক্ষমা করুন আমাদের।

২২/০৬/২১
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রায়শই আকাশ দেখি। পুরোনো অভ্যাস বলা চলে। 
দেখি, পুরো আকাশজুড়ে কোনো এক 'সবুজ' এসে মিশে যায়। ঘিরে ফেলে পুরো আসমান। জমিন থেকে আমি দেখি, আমার আকাশ। আমার চাঁদ। 
কি তাঁর জৌলুস; আলোয় আলোয় মিশ্রিত, বিস্তৃত।
 
আমার আকাশে বারোমাস একটি চাঁদই উঠে। সবুজ চাঁদ। আমি সেই সবুজকে বহুভাবে দেখি। জানি, অতঃপর মিশে যাই।
সে সবুজকে আমার বাহুডোরে আকঁড়ে রাখি, দিলে যত্ন করি। 
আমি একজন তৃষ্ণার্ত পথিক। 
আমি নিয়ম করে সবুজে সবুজ পান করি। 
উইলিয়াম কপার বলেছিলন "There is a pleasure in poetic pains, which only poets know" 

ইয়া সাইয়েদুল মুরসালিন, ইয়া খাতামুন নাবিয়্যিন; আপনার রঙয়েই তো সুখ। আপনার রঙয়েই তো তৃপ্তি।

২৩/০৬/২১

পয়লা আষাঢ়



শুরুতে বলি সায়মার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মানুষকে মুগ্ধ করার। সে সবাইকে মুগ্ধ করতে ভালোবাসে।
আমার জানা মতে, কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এই কাজটি খুব ভালোভাবে করতেন।

আজ ছিলো আষাঢ়ের প্রথম দিন।
সকাল থেকেই দফায় দফায় কখনো হালকা ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টি এবং মাঝে মাঝে প্রচণ্ড রোদ। কনফিউশন এই সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়েই সাতসকালে ঘর থেকে বেরুলাম। আষাঢ় বলে কথা; ঘরে ফিরতে ফিরতে একদফা বৃষ্টিতে ভিজতেই হলো। এ যাত্রায় বৃষ্টির গুণ কীর্তন বর্ননা করতে পারলাম না।

যাগ্গে, ঘরে আসার পরপর সায়মন সায়মার পায়চারি।
আমাদের দুজনের কথোপকথনের একাংশ;
সায়মন: আপা, চলেন আজকে আপনারে বাতিঘর থেইকা বই গিফট করি। [মুগ্ধ করার প্রথম ব্যর্থ চেষ্টা]
আমি: সায়মা আপু খুব ক্লান্ত। [গম্ভীরস্বরে] আপাতত বিরক্ত করিস না প্লিজ।

কিছুক্ষণ পর আবার;
আপা চলেন না প্লিজ...
আমি বললাম শুন বাতিঘরে বৃহস্পতিবার যাবো। সেদিন বই গিফট দিস। আজ রাখ।

কে শুনে কার কথা। এসপারওসপার সে যাবেই।
আমাকে নানাবিধ লোভনীয় অফার দিতে থাকলো। আমিও শুনতে লাগলাম। কফি খাওয়াবে, বই দিবে, পছন্দের খাতা কিনে দিবে এসব চলতেই থাকলো.....

যাই হোক লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু এটি যেনোও 'বই গিফট পাওয়ার' লোভে পড়ে গেলাম।
আমি যাবো সেই সুবাধে সায়মা খুশি। তাঁর খুশিতে আমিও খুশি।
ওয়েদারটাও উৎসবমুখর। রোদ-বৃষ্টির এলোপাথাড়ি আগমন আমার বেশ ভালো লাগে।

বাতিঘরে পৌঁছালাম। বসে আলাপ করছি। দেশ/বিদেশের সব উঠে আসছে। শঙ্খঘোষের কবিতার বই, হরিদাসের আলাপচারিতা, কিছু পত্র-পত্রিকা ঘাটাঘাটি করতে করতেই টুক করে সায়মন সায়মার একটা আবদার হাজির হলো।

সায়মা: আপা, চলেন দুই বোন মিলে একটা জমপেশ বই লিখি।
আমি: আচ্ছা। দেখি। [যথারীতি গম্ভীরস্বরে]
সায়মা খুব কনফিডেন্স নিয়ে আমাকে বুঝাচ্ছে বাজারে বইটা চলবে, দ্বীনের কাজে আসবে।
আমি হু/হা তেই পড়ে আছি। গা-ছাড়া ভাব আর কি।

কথার ফাঁকফুকুড়ে সায়মা ব্যাগ থেকে কলম আর কাগজ বের করে কি যেন একটা লিখতে লাগলো।
লেখা শেষ করে কাগজটা আমার হাতে দিলো। বলল আপা দেখেন-

কাগজটা হাতে নিলাম। আমি দেখলাম। সায়মা লিখল;

[লেখক: সালমন সালমা ও সায়মন সায়মা।
উৎসর্গ - আমাদের সর্বজয়া আম্মাকে]

কি দারুণ তাঁর অবাক করার চেষ্টা। আমি কাগজটা দেখে মুগ্ধ হলাম। সায়মার চোখেমুখে একটা উল্লাস দেখলাম। ভাবি,মানুষের উদযাপন কত সুন্দর হয়। কত পরিষ্কার হয়। আহা, সায়মন সায়মা তুজসে সেলাম!

সালমন সালমা, বাতিঘর'২১, চট্টগ্রাম।

দিনক্ষণ

বাইরে চারিদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। সব পাখপাখালি তাদের নীড়ে ঘুমাচ্ছে। কোথাও পাতা নড়বার শব্দও নেই। যেন সম্পূর্ণ প্রকৃতি ঘুমে আচ্ছন্ন, খালি জেগে আছে আকাশের বিশাল উজ্জ্বল চাঁদটা আর তার সাথী তারারা।

ভাবছি- কি ভয়ংকর কঠিন অসুখ, কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছি আমরা। গত কিছুদিন যাবৎ কোনো কাজেই পরিপূর্ণ মন লাগাতে পারছিনা। বারবার আহত হচ্ছি। পিষে যাচ্ছি। অনেকের দেওয়া কাজ লটকে আছে, নিজের একাডেমীক পড়াশোনারও তেমন ইয়াত্তা নেই। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারার বিষম যন্ত্রনা বারবার তাড়া করছে।

কিন্তু এই কঠিনসময়ে নিজেকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছি। খাতা,কলম,বই,উদযাপন,উল্লাস কোনো কিছুর সাথেই যথাযথ সখ্যতা গড়ে উঠছে না। একেবারেই না।

মনে পড়ে গেলো গতবছরের, সেপ্টেম্বর ২০২০-এর দিকে; ল্যানসেটের সম্পাদক ড. রির্চাড হর্টন তার 'কোভিড-১৯ ইজ নট অ্যা প্যানডেমিক' শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধে বলেছেন, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারি বা প্যানডেমিক নয়, বরং এটি সিনডেমিক। কমপক্ষে দুই ধরনের রোগ বা সমস্যা যদি মহামারি (এপিডেমিক) হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কোনো বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্যের (স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য) ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তবে তাকে সিনডেমিক বলা যায়।

আদৌতে কোভিড'১৯ ডে ব্যাই ডে সেদিকেই মোড় নিচ্ছে। করোনা আপনার শরীরে প্রবেশ না করলেও আপনার হাড়িতে ঠিকই প্রবেশ করছে। মরছি আমরা সবাই। কেউ ভাইরাসে, কেউবা ধুঁকে।

ভাবুন তো অতিথি হয়ে এসে আমরা পৃথিবীকে নিজেদের ভেবে তার সঙ্গে যে আচরণ করেছি, তার আলো এবং বাতাস আমাদের জন্য যে কত মূল্যবান; সেটা কিন্তু কোভিড-১৯ আমাদের নতুন করে শিক্ষা দিয়েছে। পুরো বিশ্বকে লকডাউনে রেখে ধরণী নিজের চিকিৎসা দিয়ে নিজেকে প্রাণীর বসবাসের উপযোগী করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এ পদক্ষেপ আর কতদিন চলে সেটাও আমরা ঠাউর করতে পারছি না।

কোভিড-১৯ যখন শুরু হয় তখন মোটামুটি ধারণা করা হয়েছিল ডিসেম্বর নাগাদ পরিস্থিতি শান্ত হবে, আবার জমবে মেলা, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে, কোলাহল মুখরিত জীবন ফিরে পাবে পৃথিবীর মানুষ। এর মধ্যে করোনার টিকা বের হয়ে যাবে। কিন্তু করোনার টিকা নেয়া শুরু হলেও সমগ্র বিশ্ববাসীর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হওয়ার গ্যারান্টি কারও কাছে নেই। বরং নতুনরূপে আবির্ভূত হচ্ছে এই ভাইরাস।

গতপরশু একটা সংবাদ পড়লাম, 'লকডাউনে কাজ বন্ধ, সন্তানদের খাবার দিতে না পারায় বাবার আত্মহত্যা'
চোখমুখ ঝাপসা হয়ে আসলো, খানিক চুপ ছিলাম। এমতাবস্থায় ট্রাস্ট মী কলম চলে না, এমতাবস্থায় মস্তিষ্ক পুরোদস্তর থেমে যায়। প্রিয়জন হওয়ার জন্য রক্তের সম্পর্ক জরুরি হয় না। এমন পরিস্থিতিতে উপলব্ধি হয় পৃথিবীটা সত্যিই অর্থহীন। এই যশ-খ্যাতি, অর্থ, ক্ষমতা- সবই অর্থহীন। সবাই আমরা অতিথি হিসেবে এসেছি এবং যিনি পাঠিয়েছেন তাঁর কাছেই ফেরত যেতে হবে। আমাদের জন্মই হয়েছে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য।

এইতো সেদিনের কথা, একজন ফুটফুটে এক ফুলের(২/৩ বছরের মেয়েশিশু) ছবি দিয়ে লিখলো 'ওপারে ভালো থেকো মা'। বিশ্বাস করেন আমি ফেসবুক স্ক্রলিং করার শক্তি পাচ্ছিলাম না, আঙ্গুলগুলো হাপিয়ে যাচ্ছিলো।

এমন পোষ্ট দিনরাত আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। আমি ভাঙ্গছি। আমরা ভাঙ্গছি। ক্রমাগত ভাঙ্গছি।
করোনা শরীর, মন, মাথা, পকেট, রোজগার সবকিছুতেই ভর করছে। অভাব অনটনে দিশেহারারা আত্মহত্যা করছে, এ মরন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর চেয়ে কম কিসের?

সন্ধ্যায় ডাক্তার রাকিবুল আমিন বিজয় ভাই জানালেন, এক পরিবার বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়ে গোটা পরিবারই এখন করোনায় আক্রান্ত, ট্রিটমেন্টে। পরিবারের তরতাজা ছোট ভাইটা মারা গেলো, মা'কে আইসিউতে রাখা হয়েছে। সত্যিই আমরা উন্মাদ। আমরা ভোজনরসিক। কি দারুণভাবে ডাক্তারখানাকে আমরা মৃত্যুপুরি বানাচ্ছি!

খেয়াল করেন, আক্রান্তর সংখ্যা বাড়ছে। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা যত বেশি অসচেতন হবো, মাথায় রাখতে হবে আমাদের চাকরি বন্ধের মেয়াদ তত বেশি বাড়বে। ঘরে বেতন ঢুকবে না, খাদ্যে জোগানে হিমশিম খাবো। বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য তাগাদা দিবে, আশ্রয়হীন হবো.......
এতে করে আমাদের সুবিধে হবে না নিশ্চয়ই?
তাই কষ্ট করে একটু সচেতন থাকেন। আতংকিত হয়ে আত্মহত্যা করার দরকার নাই, এটাতো ফাইনাল সমাধান না। যদি তিনবেলা খাবার না জুটে তাহলে একটা ট্রিকস ফলো করেন; কিছু একটা খেয়ে সেহেরি করেন, সারাদিন রোজা রাখেন। ইবাদত হবে, খাবার জোগানের পেরেশানিটাও কমবে। (পরিবারের বাচ্চাদের জন্য এই ট্রিকস না)। বিশ্বাস করুন আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি জগতের সকল কিছুকে রিযিক প্রদান করছেন। তিনিই উত্তম রিযিকদাতা। দ্যাটস এনাফ।
‘আল্লাহুম্মা রাব্বানা আনযিল আলাইনা মায়িদাতাম মিনাস সামায়ি তাকুনু লানা ঈদাল্লি আওওয়ালিনা ওয়া আখিরিনা ওয়া আয়াতাম মিনকা ওয়ারযুকনা ওয়া আনতা খায়রুর রাযিকিন।’ [আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে এ দোয়াটি বেশি বেশি পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন]

মনে রাখতে হবে কঠিন এই সময়টা সবার জন্য এক। সবার জন্য কঠিন। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার জন্য। কাউকে দোষ দেওয়ার সময় এটা না। ভাববেন না সরকার, ওই মন্ত্রী, সেই মন্ত্রী বা অমুককে, তমুককে দু'চারটা গালি দিলে করোনা আপনাকে এ্যাটাক করবে না ; তা কিন্তু নয়। তারচে বরং যতটুকু সামর্থ্য আছে তা দিয়ে যেখানে সাহায্য করা দরকার, করুন। দল-মত নির্বিশেষে করুন। তবে জনসমাগম নয়, ফটোসেশন নয়, এতে দুঃখ বাড়বে আরো। আপনার সাহায্য সুখ বয়ে আনুক,ক্ষতি না এটাই আমাদের কাম্য।

দুস্তর এইসময়ে বেশি বেশি দুরুদ পড়ুন। ইস্তেগফার পাঠ করুন। আল্লাহতালার দরবারে তওবা করুন। ক্ষমা চান। পরিত্রাণের জন্য দরখাস্ত করুন।
জানুন, এটা পরীক্ষা। আল্লাহর তরফ থেকে দেয়া পরীক্ষা। আমরা নিশ্চয়ই সবর করব। আমরা নিশ্চয়ই শোকর আদায় করব। আমরা জানি তিনি আমাদের ভালোবাসেন, আমরা তাঁকে স্মরণ করব।
মোদ্দাকথা,
সবার সুস্থতার জন্য দু'আ করুন। রিজিকের জন্য দু'আ করুন। মা-বাবা, পরিবার, আত্মীয়স্বজন, অফিসের কলিগ, সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশি সবার জন্য দু'আ করুন। হ্যা, শত্রুর জন্যও দু'আ করুন। যে আপনার বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্যও দু'আ করুন। এই সময়টা দু'আ করার। প্রতিটি ফুল তাঁর সুভাসে জড়িয়ে রাখুক গোটা পৃথিবীকে। আপনার প্রতি ওয়াক্তের মুনাজাতে প্রতিটি নাম আসুক।
প্রতিটি প্রাণ বেঁচে থাকুক। কোনো এক বনী আদমের কষ্ট, আমাদের কষ্ট। তাঁর চিৎকার, আমাদের চিৎকার। ইয়াদ রাখনা একজন উম্মতে মুহাম্মদীর হাহাকার, আমাদেরও হাহাকার।

রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা।
ওয়া আখিরু দাওয়ানা আনিল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। আস-সালামু আলাইকুম।

- সালমন সালমা / চট্টগ্রাম'২১

আম্মা- আমাদের মুশকিলে আসান।




বেশ কিছুদিন ধরে একটা যন্ত্রণায় ভুগছি। কলম দিয়ে কালি বের না হলে, ভিতরটা কেমন যেনো হাহাকার করে। এ তীক্ষ্ম যন্ত্রণা- অনুভূতিও বলা যায়, অনুভূতিই এমন সময় যন্ত্রণার আকার ধারণ করে- কাউকে বুঝানোর মতো নয়। আজ অবধি কোনো প্রিয় মানুষকে নিয়ে দু’চার লাইনের বেশি লিখতে পারিনি। কোনো এক অদ্ভূত কারণে কলম থেমে যায়। উপমারা সব লুকিয়ে পড়ে। শব্দভাণ্ডারে কপাট লেগে যায়। তাই কোনো শব্দ নয়, কিছু পরমাত্মিক আবেগ নিয়েই আজ রচনা করতে বসলাম আমার আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশকে।


তিনি আমার আম্মাজান। যিনি আমাদের সাক্ষাত আদর্শ। এই জগৎ সংসারে আমাদের সকল সময়ের একমাত্র নীরব সাক্ষী।  তিনি আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্য কোনো ভুবনে। তাঁর আজ ৩৬৫ দিন। এই ইট বালুর শহরে শেষ বিকেল অদ্ভূত সুন্দর আর উপভোগের। ঠিক তেমনি এক পড়ন্ত বিকেল, বৃহস্পতিবার। দুপুরের আকাশে ছিলো একঝাঁক মেঘ। আলো-আধারের ছন্দপতনে বিকেল ঘনালো। আসরের ওয়াক্ত। তাঁরপর হঠাৎ পাখির পাখা ঝাপটানোর শব্দ। আমি কান পেতে শুনছি সেই পাখার উত্তাল আওয়াজ। বাতাসে কি যেনো সংবাদে ভেসে আসছে আমাদের দুয়ারে। খানিকবাদে আম্মা চোখ বুঝলেন। একটা নির্জন, নিঃসঙ্গ বিকেল আমাদের আলিঙ্গন করলো। আমি আম্মার মুখের দিকে তাকালাম, মনে হলো কোনো আকাশ দেখছি- শরতের নীলাভ আকাশ। কি পবিত্র আর নির্মল মুখখানা। শেষবারের সাক্ষাতে আম্মার এই পবিত্র মুখখানাই রাখলাম আমার হৃদপকেটে। খুব যত্নে, তবে নীরবে।

আব্বা যেনো গলাকাটা কবুতরের মতো ছটফট করছেন। আর আমি মুহূর্তের মধ্যে আচমকা বড়ো হয়ে গেলাম, অনেক বড়ো। আমার মাথা ঘরের ছাঁদ ফুঁড়ে আকাশ ছোঁয়ার মতো বড়ো।  

তিন অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ- বিদায়। মাত্র তিন অক্ষর। তাঁর সাথে আমাদের নতুন করে পরিচয় হলো। আমরা নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু শব্দটি আপাদমস্তক বিষাদে ভরা। বিদায়ের শেষবেলা মনটা কেন যেন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। কারণ এই যে, বিদায় হচ্ছে বিচ্ছেদ। আর প্রত্যেক বিচ্ছেদের মাঝেই নিহিত থাকে নীল, গাঢ় নীল কষ্ট। প্রিয় মানুষের বিয়োগ, আমাদের জীবনে এই প্রথম অভিজ্ঞতা। তাঁরপর থেকে আজ... গোটা একটা বছর। 

এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি, আম্মা নেই। তাই আমি খিলখিল করে চলতে পারি। আম্মার গড়া জীবনের জন্য আমরা বুক ফুলিয়ে দাপিয়ে বেড়াই। জীবনের পরতে পরতে আম্মাকে কাছে পাই। বলতে গেলে আম্মা ছিলেন আমাদের মুশকিলে আসান। কত কিছু চোখের সামনে রেখেও খুঁজে পেতাম না, আম্মা খুঁজতে গেলেই ম্যাজিক ঘটতো। জানিনা কি অদ্ভুত নিয়মে আজো এটা ঘটে! কিছু খুঁজতে খুঁজতে যখন পাগলপারা ঠিক সেই মুহূর্তে চোখের সামনেই পেয়ে যাই। তাই মনে হয়, আম্মা অলওয়েজ আমাদের খুবই নিকটে থাকে। আমাদের গোটা বসবাস জুড়েই আম্মার অবস্থান। মনে হয়, আম্মার অশরীরি আত্মা আমাদেরকে দেখছেন, নীরবে নিভৃতে পাহাড়া দিচ্ছেন তাঁর বুকজোড়া মাণিকদের। শারীরিক আমরা মাঝেমধ্যে শারীরিক দুর্বলতাঁর ঊর্ধ্বে উঠি অনুভূতির জোরে, তখন আমরা অনুভব করি এমন।

আমাদের জীবনে অনেক কিছুই ঘটেছে।  যা যা জীবনে চাইনি তা তা পেয়েছি। আবার যা আঁকড়ে ধরে সারাটা জীবন বাঁচতে চেয়েছিলাম তা তা হারিয়েছি। বলতে গেলে আম্মা অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। তাঁর মধ্যে গোটা শ’খানেক বই, একজোড়া কলম,  আম্মার কষ্টার্জিত মানুষের মহব্বত, আমাদেরকে সুশিক্ষা, আর একটা সুন্দর মন। যা দিয়ে গোটা জীবনটা রাজার হালে কাটিয়ে দিতে পারবো। 

আমাদের আম্মা ছিলেন যুগের চেয়ে এক কদম এগিয়ে। অসম্ভব আধুনিকমনা একজন মানুষ। অসম্ভব তেজীয়ান আর সাহসী।  আচারে ছিলো বিনয়, শব্দে ছিলো নম্রতা। আম্মা কোনোদিন কারোর মনে কষ্ট দিতেন না। এটা আমি ছোটো থেকে দেখেছি তবে উপলব্ধি করতে পেরেছি আম্মা চলে যাওয়ার পর। অনেক মানুষ আমার সাথে দেখা করে এসব বলতেন। আম্মা কিভাবে তাদের হেল্প করেছিলেন বা আম্মার কিঞ্চিৎ সুপারিশে অনেক কাজ কতো সহজ হতো। প্রতিনিয়ত এসব শুনতাম আর মুগ্ধ হতাম। এমন মায়ের সন্তান হিসেবে রোজ আমরা গর্ববোধ করি। 

আমার মনে আছে ইন্টার পরীক্ষার পরপর আম্মা আমাকে তাগাদা দিতে শুরু করলেন ‘কিছু একটা কর,  কিছু একটা কর’। জীবনে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার গুরুত্ব প্রথম জানতে পেরেছি আম্মার কাছেই। যদিও আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক তিনিই। দীর্ঘ সময় তাঁর শাসনেই তটস্থ ছিলাম আমরা। আমাদের ব্যাপারে যতটা উদার ছিলেন ঠিক ততটাই কঠোর ছিলেন। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবচে বেশি কনফিডেন্ট ছিলেন আম্মাই। তিনি জানতেন আমরা স্বপ্নতক পৌঁছবো। আম্মার আধবয়স কেটেছে কেবল আমাদের পড়াশোনার পিছনে। একাডেমিক পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি খুব সেন্সিটিভ ছিলেন। একহাতে সব সামলাতেন। 

এইতো সেদিন সায়মার সাথে কোচিং-এ গিয়ে দুই ঘণ্টা বসেছিলাম। সাথে মোবাইল ছিলো। গেম খেলছিলাম, বাট কি ঝিমানোই না আসছিলো! মনে মনে চরম বিরক্ত হচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ আম্মার কথা মনে পড়লো। কত বিকেল,  কত সন্ধ্যা আম্মার এমন কোচিং এর বাইরে কেটে যেত আমার জন্য, আমাদের জন্য। তাঁর তো সময় কাটানোর জন্য মোবাইল বা গেম ছিলো না। তখন ভাবলাম, না জানি আম্মারা কত ধৈর্যশীল হোন! আম্মারা কেবল আম্মা হন না, সাথে সাথে আরও অনেক কিছু হন। 

এসএসসির আগ মুহূর্তটা কড়া শাষনে আমরা বড় হই। দিনরাত পড়াশোনা। কঠোর সাধনা। অধিকাংশ চাপই আম্মার মাথায়। আমি রাত জেগে পড়তাম আম্মা পাশে বসে থাকতেন, আর টেবিলে ঝিমাতেন। তবুও আমাকে একা ফেলে যেতেন না। আমি ঘুমালে তবেই আম্মা কিছুসময় চোখ বুঝতেন।  আমি অনেকের মা’কে এখন দেখি। কাউকে আম্মার মতো দেখি না। 

আমাদের পড়াশোনার প্রতি তিনি পাগলের মতো যত্নবান ছিলেন। তিনি কোনোদিন প্রতিযোগিতায় নামাতেন না, জিততে হবেই এসব শেখাতেন না। তবে তিনি বলতেন তুমি তোমার সেরাটা দাও, প্রচুর পরিশ্রম করো বাকিটুকু আল্লার হাতে। আজতক এভাবেই চলছে আমাদের জীবনযাপন। 

ছোটোবেলার একটা ব্যাপার খুব মনে পড়ে, আম্মার মুখ থেকেই প্রথম সুরা, দুরুদ শেখা। রাতে পড়া শেষ করে আমাদের নিয়ে শুয়ে পড়তেন তাঁরপর দুরূদপাঠের, সুরাপাঠের অনুশীলন চলতো। এভাবেই আমাদের মুখ থেকে দরূদ ঝড়তো। বুকে তাঁর কদর তৈরি হলো আম্মার জন্যই। 

আম্মাকে আমি আমার এলার্ম ঘড়ি বলতাম সবসময়। এই রহস্য আমি আজো খুঁজে পাই না। শেষ রাতে শুয়েও কি করে তিনি ফজরের নাগাল পেতেন। আমি ফজরের পর পড়তে বসতাম। এখন ভাবি আম্মা মনে হয় ঘুমাতেনই না, কেবল চোখজোড়াকে একটু বিশ্রাম দিতেন। 

আমার বুকে রক্তহরন হয়, আম্মা। জীবনের প্রতিটি রাত কি অসহনীয় লড়াইটা করলেন আমাদের জন্য। ভোর থেকে আবার সেই একঘেয়ে ব্যস্ত জীবন। আপনার শান্ত শীতল বুকটাই ছিলো আমাদের শেষ আশ্রয়। আম্মার নেউটা ছিলাম আমরা। আমাদের আম্মা মুক্তমনা মানুষ ছিলেন। কোনোদিন আমাদের শেকলে বাঁধতেন না, প্রাণে বাঁধতেন। হ্যাপী পেরেন্টিং বোধহয় এটাই। আমাদের সব আবদারের ঘাঁটি ছিলো আম্মার আঁচল। চুপিসারে আধোভাঙ্গা শব্দগুলো দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতাম, আম্মা ঠিক বুঝতেন। 

আম্মার রুচিবোধ আমাদের চেয়ে ঢের ভালো। সৌন্দর্য বলতে আম্মা বুঝতেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি।  কাজের ক্ষেত্রেও তাই। আম্মা আমাদেরকে সবসময় বলতেন “জীবনে অনেক কাজ করতে হবে তা নয়, যেটুকু করবে মন দিয়ে করবে।  পারফেকশন ইজ মোষ্ট ইম্পরট্যান্ট।” এসব আমাদের জীবনের সূত্র। এসব ধরেই পথ আগাচ্ছি।   

আম্মাকে কোনোদিন দেখিনি আয়নার সামনে কিছু মুহূর্ত কাটাতে। কিন্তু তিনি অসম্ভব সুন্দর ছিলেন। আমার আম্মাই মনে হয় এমন নারী যারে কোনোদিন আমি কাজল পড়তে দেখিনি। তাঁর ধবধবে চোখগুলো সবসময় আমাদের কাছে প্রিয় ছিলো। 

আম্মা প্রচন্ড সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন। তবে খুব উল্লাসপ্রিয় ছিলেন। আম্মা অবাধ মেলামেশা অপছন্দ করতেন। কিন্তু উদযাপনে পিছপা হতেন না। আম্মা মুহূর্তকে নিয়ে মাততেন সবসময়। ব্যাক্তিগতভাবে আমি নিজেও উদযাপন প্রিয় মানুষ। উদযাপন বাড়তি কিছু সময় বেঁচে থাকার রসদ যোগান দেয়, এটা আম্মার কাছ থেকেই শেখা। বৃষ্টির সময় আমরা আম্মার দিকে তাকালেই তিনি বুঝতে পারতেন আমরা খিচুড়ি খেতে চাই। আমাদের চোখের ভাষা, আমাদের খাবারের স্বাদ সবটুকুই আম্মার তদারকিতে হতো। 

ছোটো থেকে আমি খুব একটা মানুষের সাথে মিশতাম না; অপরিচিত কারোর সাথে নিজেকে কমফোর্ট ফিল হতো না। সেই সুবাধে আমার প্রথম বন্ধু আম্মাই। আমি ছিটেফোঁটা যতটুকু ক্রিয়েটিভ, তাঁর সবটুকু অবদান আম্মার। তাকে ছাড়া আমার সাহিত্যচর্চা প্রায় অসম্ভব ছিলো। তিনি দুর্দান্তরকমের একজন শৈল্পিক মানুষ ছিলেন। কি দারুণ ছিলো তাঁর কারুকাজ। আমার লেখালেখির হাতেখড়ি আম্মার বদৌলতে। ছোট্টবয়সে দৈনিক দিনলিপি লিখাতেন। ক্লাস থ্রী/ফোরে পড়ি তখন। লাল মলাটে বাধা পুরাতন কিছু খাতা। স্কুল থেকে ফিরলেই আম্মাকে বিরক্ত করবো বলে তিনি সেই খাতা আর পেন্সিল দিয়ে বলতেন সকাল থেকে স্কুলে কি কি করছো লিখো। আমিও বানিয়ে বানিয়ে লিখতাম। সেখান থেকেই গল্প লেখা শুরু, কাগজ কলমের সাথে প্রেম... আমার জীবনে তাঁর অবদান প্রতিটা সেক্টরেই। আম্মা চমৎকার আঁকতেন। তাঁর হাতেই আঁকা শিখে বহুবার প্রাইজ পেয়েছি। আমাদের সর্বোচ্চ সফলতাই ছিলো আম্মার সম্মানি। 

ইন্টারের দিকে আমি এক কোচিং-এ পড়ি। আম্মা আমার সাথে নিয়মিত যান।  হঠাৎ একদিন, কোত্থেকে এক ছেলে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো। পড়ে দেখলাম ফটোগ্রাফি কোর্সের। তাও ফ্রী। আম্মা জোর করে বললেন করতে। তিনমাস, সপ্তাহে একদিন। করলাম। বাট চালিয়ে গেলাম না। ব্যাপারটা, কাকপক্ষীও জানতে পারেনি। আম্মার এমন অনেক শৌখিনতা আমাকে দিয়ে পূরণ করেছিলো। এটাই ছিলো তাঁর আনন্দ।  

আমি উদ্ভট পাগলাটে ছিলাম। রাগও ছিলো প্রচণ্ড। আম্মা যদিও আমার সরলতাকেই বেশি পছন্দ করতেন। আমার স্বাভাবিক চলাফেরা। আর পাঁচজন থেকে একটু ভিন্ন ভাবনা। ইন্টারের পর আমি একটু একটু বড়ো হলাম। তখন প্রচুর স্বপ্ন দেখতাম। আর সেই স্বপ্নগুলো কেবল আম্মাকেই বলতাম। তিনি কেমন জানি ভরসা দিতেন। তাঁর বুকভরা আশা ছিলো আমরা তিনবোন একদিন বড়ো হবো। অনেক বড়ো। আমাদের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিলো। তিনি বারোমাস চাইতেন আমরা যেনো সুস্থ মানুষ হই। আমরা যেনো সবার হকটা বুঝি। 


তাঁর বোনা স্বপ্নগুলো আমাদের কাছে তিনি আমানত রাখতেন। 

তবে ভালো মানুষ হওয়ার লোভ জন্ম থেকেই আমাদের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন- “রুজিরোজগার যাই হোক না কেনো,  ভালো মানুষের মতো সুখি না-কি এ পৃথিবীতে আর কেউ নাই”। তিনি বলতেন- “তোমরা উদার হও। জীবনে যত বড়োই হও না কেনো, বিনয় থেকো।” 

আমার বই পড়া, বইয়ের সাথে সখ্যতা সবকিছু আম্মার জন্য। তিনি ছোটোবেলায় খেলা বলতে বুঝিয়েছেন বইকে। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে মানুষ-গোনা খেলতাম। অনেকবার আম্মার সাথে খেলেছি এই খেলা।  

আম্মার চাবির তোড়ার শব্দ খুব মিস করি। বাড়িতে তিনি যখন হাঁটতেন, বুঝতে পারতাম আম্মা হাঁটছেন। গত ৩৬৫ দিন অনেকের চাবির তোড়ার শব্দ শুনি কিন্তু আম্মার চাবির তোড়ার মতো শব্দ কানে ভাসে না। 

আজকে আম্মার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমাদেরকে উনি একটা সুস্থ পরিবেশে লালন পালন করেছেন। সুস্থ ও দৃঢ় মনমানসিকতা তৈরিতে জোর দিতেন। আর অসম্ভব সুন্দর ছোটবেলা আর কৈশোর উপহার দিয়েছেন। আজকে আমরা যতটা ভালো দিনাতিপাত করছি তার একমাত্র কারণ আম্মার খাস কর্মের জন্য। কোনো একজনকে বলতে শুনেছি, মা-বাবার ভালো কৃতকর্মের ফল সন্তানরা ভোগ করে। আমাদের জন্য এর সর্বোচ্চ উদাহরণ আমরাই। 

আম্মা, আপনার পরকালযাত্রা দেখে আমি তৃপ্ত হয়েছিলাম। এমন হালতেই আপনি যেতে চেয়েছিলেন। আল্লা- আমার আম্মাকে জান্নাতের উঁচু মকাম দান করুন, আমিন।  

আম্মা, আমি আবাবিল পাখির অপেক্ষায় আছি। যদি তারে দিয়ে আপনার কাছে আমাদের সুখে থাকার বার্তাটা পৌঁছানো যায় তাই। আম্মা, আপনার দেখানো পথটা অনেক কষ্টের। তাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আপনি বলতেন ‘বাপ, তুমি পারবে’- আপনার একটা কথাই আমার জীবনের সেরা মোটিভেশনাল লাইন। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে আমাকে সুরা কেরাত পড়ে মাথায়, বুকে ফুঁ দিয়ে দিতেন। আমার জীবনের সর্বোচ্চ কঠিন পরীক্ষাগুলোও কেমন যেনো সহজ হয়ে যেতো। আম্মা, এবারো আপনি একটা ফুঁ দেন, যাতে আমার সব কাজ সহজ হয়। আপনার ফুঁ আমাদের বুককে বড়ো করে, সাহস বাড়ায়। 

আম্মা আপনাকে বলি, আমাদের সকল অর্জন আপনার। আমাদের সকল উপার্জন আপনার। সন্তান হিসেবে আপনার কদমে সব উৎসর্গ। আপনার মতো উৎফুল্ল-আহ্লাদি মা দুনিয়াতে বিরল। আম্মা, জানেন? কলম থেকে বের হওয়া প্রতিটি কালির ফোটা বেয়ে আমার চোখের জল কাগজে টপটপ করে পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের মতো। আপনার প্রিয় শব্দ। আপনাকে কদমবুসি, আম্মা।

রমজানে মী-টাইম, উই-টাইম বের করা খুব টাফ ছিলো। রমজানের একটা ব্যস্ততা তো থাকেই তার সাথে সাথে সবার অফিসের কাজের চাপ। সবমিলিয়ে আমরা একসাথে থাকলে...