বাইরে চারিদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। সব পাখপাখালি তাদের নীড়ে ঘুমাচ্ছে। কোথাও পাতা নড়বার শব্দও নেই। যেন সম্পূর্ণ প্রকৃতি ঘুমে আচ্ছন্ন, খালি জেগে আছে আকাশের বিশাল উজ্জ্বল চাঁদটা আর তার সাথী তারারা।
ভাবছি- কি ভয়ংকর কঠিন অসুখ, কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছি আমরা। গত কিছুদিন যাবৎ কোনো কাজেই পরিপূর্ণ মন লাগাতে পারছিনা। বারবার আহত হচ্ছি। পিষে যাচ্ছি। অনেকের দেওয়া কাজ লটকে আছে, নিজের একাডেমীক পড়াশোনারও তেমন ইয়াত্তা নেই। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারার বিষম যন্ত্রনা বারবার তাড়া করছে।
কিন্তু এই কঠিনসময়ে নিজেকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছি। খাতা,কলম,বই,উদযাপন,উল্লাস কোনো কিছুর সাথেই যথাযথ সখ্যতা গড়ে উঠছে না। একেবারেই না।
মনে পড়ে গেলো গতবছরের, সেপ্টেম্বর ২০২০-এর দিকে; ল্যানসেটের সম্পাদক ড. রির্চাড হর্টন তার 'কোভিড-১৯ ইজ নট অ্যা প্যানডেমিক' শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধে বলেছেন, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারি বা প্যানডেমিক নয়, বরং এটি সিনডেমিক। কমপক্ষে দুই ধরনের রোগ বা সমস্যা যদি মহামারি (এপিডেমিক) হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কোনো বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্যের (স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য) ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তবে তাকে সিনডেমিক বলা যায়।
আদৌতে কোভিড'১৯ ডে ব্যাই ডে সেদিকেই মোড় নিচ্ছে। করোনা আপনার শরীরে প্রবেশ না করলেও আপনার হাড়িতে ঠিকই প্রবেশ করছে। মরছি আমরা সবাই। কেউ ভাইরাসে, কেউবা ধুঁকে।
ভাবুন তো অতিথি হয়ে এসে আমরা পৃথিবীকে নিজেদের ভেবে তার সঙ্গে যে আচরণ করেছি, তার আলো এবং বাতাস আমাদের জন্য যে কত মূল্যবান; সেটা কিন্তু কোভিড-১৯ আমাদের নতুন করে শিক্ষা দিয়েছে। পুরো বিশ্বকে লকডাউনে রেখে ধরণী নিজের চিকিৎসা দিয়ে নিজেকে প্রাণীর বসবাসের উপযোগী করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এ পদক্ষেপ আর কতদিন চলে সেটাও আমরা ঠাউর করতে পারছি না।
কোভিড-১৯ যখন শুরু হয় তখন মোটামুটি ধারণা করা হয়েছিল ডিসেম্বর নাগাদ পরিস্থিতি শান্ত হবে, আবার জমবে মেলা, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে, কোলাহল মুখরিত জীবন ফিরে পাবে পৃথিবীর মানুষ। এর মধ্যে করোনার টিকা বের হয়ে যাবে। কিন্তু করোনার টিকা নেয়া শুরু হলেও সমগ্র বিশ্ববাসীর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হওয়ার গ্যারান্টি কারও কাছে নেই। বরং নতুনরূপে আবির্ভূত হচ্ছে এই ভাইরাস।
গতপরশু একটা সংবাদ পড়লাম, 'লকডাউনে কাজ বন্ধ, সন্তানদের খাবার দিতে না পারায় বাবার আত্মহত্যা'
চোখমুখ ঝাপসা হয়ে আসলো, খানিক চুপ ছিলাম। এমতাবস্থায় ট্রাস্ট মী কলম চলে না, এমতাবস্থায় মস্তিষ্ক পুরোদস্তর থেমে যায়। প্রিয়জন হওয়ার জন্য রক্তের সম্পর্ক জরুরি হয় না। এমন পরিস্থিতিতে উপলব্ধি হয় পৃথিবীটা সত্যিই অর্থহীন। এই যশ-খ্যাতি, অর্থ, ক্ষমতা- সবই অর্থহীন। সবাই আমরা অতিথি হিসেবে এসেছি এবং যিনি পাঠিয়েছেন তাঁর কাছেই ফেরত যেতে হবে। আমাদের জন্মই হয়েছে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য।
এইতো সেদিনের কথা, একজন ফুটফুটে এক ফুলের(২/৩ বছরের মেয়েশিশু) ছবি দিয়ে লিখলো 'ওপারে ভালো থেকো মা'। বিশ্বাস করেন আমি ফেসবুক স্ক্রলিং করার শক্তি পাচ্ছিলাম না, আঙ্গুলগুলো হাপিয়ে যাচ্ছিলো।
এমন পোষ্ট দিনরাত আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। আমি ভাঙ্গছি। আমরা ভাঙ্গছি। ক্রমাগত ভাঙ্গছি।
করোনা শরীর, মন, মাথা, পকেট, রোজগার সবকিছুতেই ভর করছে। অভাব অনটনে দিশেহারারা আত্মহত্যা করছে, এ মরন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর চেয়ে কম কিসের?
সন্ধ্যায় ডাক্তার রাকিবুল আমিন বিজয় ভাই জানালেন, এক পরিবার বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়ে গোটা পরিবারই এখন করোনায় আক্রান্ত, ট্রিটমেন্টে। পরিবারের তরতাজা ছোট ভাইটা মারা গেলো, মা'কে আইসিউতে রাখা হয়েছে। সত্যিই আমরা উন্মাদ। আমরা ভোজনরসিক। কি দারুণভাবে ডাক্তারখানাকে আমরা মৃত্যুপুরি বানাচ্ছি!
খেয়াল করেন, আক্রান্তর সংখ্যা বাড়ছে। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা যত বেশি অসচেতন হবো, মাথায় রাখতে হবে আমাদের চাকরি বন্ধের মেয়াদ তত বেশি বাড়বে। ঘরে বেতন ঢুকবে না, খাদ্যে জোগানে হিমশিম খাবো। বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য তাগাদা দিবে, আশ্রয়হীন হবো.......
এতে করে আমাদের সুবিধে হবে না নিশ্চয়ই?
তাই কষ্ট করে একটু সচেতন থাকেন। আতংকিত হয়ে আত্মহত্যা করার দরকার নাই, এটাতো ফাইনাল সমাধান না। যদি তিনবেলা খাবার না জুটে তাহলে একটা ট্রিকস ফলো করেন; কিছু একটা খেয়ে সেহেরি করেন, সারাদিন রোজা রাখেন। ইবাদত হবে, খাবার জোগানের পেরেশানিটাও কমবে। (পরিবারের বাচ্চাদের জন্য এই ট্রিকস না)। বিশ্বাস করুন আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি জগতের সকল কিছুকে রিযিক প্রদান করছেন। তিনিই উত্তম রিযিকদাতা। দ্যাটস এনাফ।
‘আল্লাহুম্মা রাব্বানা আনযিল আলাইনা মায়িদাতাম মিনাস সামায়ি তাকুনু লানা ঈদাল্লি আওওয়ালিনা ওয়া আখিরিনা ওয়া আয়াতাম মিনকা ওয়ারযুকনা ওয়া আনতা খায়রুর রাযিকিন।’ [আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে এ দোয়াটি বেশি বেশি পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন]
মনে রাখতে হবে কঠিন এই সময়টা সবার জন্য এক। সবার জন্য কঠিন। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার জন্য। কাউকে দোষ দেওয়ার সময় এটা না। ভাববেন না সরকার, ওই মন্ত্রী, সেই মন্ত্রী বা অমুককে, তমুককে দু'চারটা গালি দিলে করোনা আপনাকে এ্যাটাক করবে না ; তা কিন্তু নয়। তারচে বরং যতটুকু সামর্থ্য আছে তা দিয়ে যেখানে সাহায্য করা দরকার, করুন। দল-মত নির্বিশেষে করুন। তবে জনসমাগম নয়, ফটোসেশন নয়, এতে দুঃখ বাড়বে আরো। আপনার সাহায্য সুখ বয়ে আনুক,ক্ষতি না এটাই আমাদের কাম্য।
দুস্তর এইসময়ে বেশি বেশি দুরুদ পড়ুন। ইস্তেগফার পাঠ করুন। আল্লাহতালার দরবারে তওবা করুন। ক্ষমা চান। পরিত্রাণের জন্য দরখাস্ত করুন।
জানুন, এটা পরীক্ষা। আল্লাহর তরফ থেকে দেয়া পরীক্ষা। আমরা নিশ্চয়ই সবর করব। আমরা নিশ্চয়ই শোকর আদায় করব। আমরা জানি তিনি আমাদের ভালোবাসেন, আমরা তাঁকে স্মরণ করব।
মোদ্দাকথা,
সবার সুস্থতার জন্য দু'আ করুন। রিজিকের জন্য দু'আ করুন। মা-বাবা, পরিবার, আত্মীয়স্বজন, অফিসের কলিগ, সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশি সবার জন্য দু'আ করুন। হ্যা, শত্রুর জন্যও দু'আ করুন। যে আপনার বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্যও দু'আ করুন। এই সময়টা দু'আ করার। প্রতিটি ফুল তাঁর সুভাসে জড়িয়ে রাখুক গোটা পৃথিবীকে। আপনার প্রতি ওয়াক্তের মুনাজাতে প্রতিটি নাম আসুক।
প্রতিটি প্রাণ বেঁচে থাকুক। কোনো এক বনী আদমের কষ্ট, আমাদের কষ্ট। তাঁর চিৎকার, আমাদের চিৎকার। ইয়াদ রাখনা একজন উম্মতে মুহাম্মদীর হাহাকার, আমাদেরও হাহাকার।
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা।
ওয়া আখিরু দাওয়ানা আনিল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। আস-সালামু আলাইকুম।
- সালমন সালমা / চট্টগ্রাম'২১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন