শনিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২১

প্রতিটা মায়ের মৃত্যুর সংবাদ—
আমার মায়ের মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। 

২৩/১০/২১

শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০২১

আমি যে 'বিদ্যা' সবসময় ভয় পাই— সেটি হলো 'অল্প বিদ্যা'।

২২/১০/২১

কাজলের বয়ে বেড়ানো সুখ



কাজলের বয়ে বেড়ানো সুখ
-সালমন সালমা।

কোনো এক শীতের সকাল, যে শীত অন্যসব ঋতু থেকে আলাদা। যে সকাল অন্যসব সকাল থেকে আলাদা। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো গোটাশহর যেনো নিশ্চুপ, হাড় শীতল করে প্রকৃতির পাখপাখালি, কর্মস্থলের যন্ত্রপাতিও যেনো ফ্রিজ হয়ে আছে। এ সময় এক ফালি রোদ সকলের কাছে বহুল প্রতীক্ষিত হয়ে ওঠে। শীতের সকালে মানুষের মাঝে এক অজানা অলসতা ভর করে। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকাতেই যেন তখন স্বর্গীয় সুখ অনুভব হয়। কিন্তু জীবিকার তাগিদে, জীবন থেমে থাকে না, বেঁচে থাকার বাস্তবতা শীতকেও দূরে সরিয়ে দেয়। কম্বল নামিয়ে, আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই হয় সবাইকে। নিজেকে তৈরি করে নিতে হয় কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। 


তদ্রূপ এমন এক শীতের সকাল। শনিবার। সদ্য কলেজ পড়ুয়া এক তরুন, কাজল।  আজ তার কলেজ ছুটি। তাই সকালে তার বাড়ির পাশের মামার টং দোকানে এসেছে চা খেতে। সকাল ৭ টার নাগাদ। কাজল, এসে দেখে মামা দোকান খুলছে মাত্র। 


কাজল: মামা আইজ এতো দেরি কেন? 

মামা: আর কইয়েন না যেই শীত পড়চে, বউ পোলাপানের কথা ভাইবা দোকানটা খুললাম। বয়েন মামা। 


কিছুক্ষণ পর মামা চা দিলো, 

কাজল চায়ে চুমুক দিতে দিতে খেয়াল করতে লাগল মামার দোকানের দক্ষিণ দিকে, সাদামাটা একটা ছেলে, এই বছর ১১ কিংবা ১২ এর মতো হবে।


কাজল দেখছে, 

সূর্যের বিদায় বেলার আলোতে কি পবিত্র ছোঁয়ায় ছেলেটির ঘুম ভাঙ্গছে। সে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখে সকাল হয়ে গেছে। তারপর সে তার ঘাসের বিছানা ছেড়ে উঠে। রাজার আবেশে, একটা বড়ো  গাছের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে। কাজল ভাবছে সেটিই বোধহয় ছেলেটির থাকার জায়গা। 

ছেলেটি তার নিষ্পাপ চোখ দিয়ে এপাশ- ওপাশ তাকিয়ে চিন্তা করতে থাকে, সকাল তো হলো এখন কি খাবো? খাবার কোথাই'বা পাবো? রাতে খেতে না পারায় পেটে অসহ্য খিদে লেগেছে। 


কিছুক্ষণ পড়েই ছেলেটার নাকে একটা সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। যে ঘ্রাণটা ভদ্র সমাজে খুব বাজে ঘ্রাণ বলে মনে হয়। কাজল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে, ছেলেটির মুখে এক বর্ণ হাসির ছোরা মিলছে। কাজল পাশ ফিরে দেখে ডাষ্টবিন থেকে একটা বাজে গন্ধ আসছে। যে গন্ধ কাজলেরও সহনীয়তার বাইরে। কিন্তু ছেলেটি দৌড়ে ডাস্টবিনটার পাশে এসে দাঁড়ায়, ভালো মন্দ কিছু ফেলে দেওয়া খাবার পাবে বলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য  ডাষ্টবিনে খাবার মতো কিছুই পায়নি। কাজল বিষয়টা বুঝতে পারে। ছেলেটি গুটি গুটি পায়ে আবার সেই জায়গায় গিয়ে বসে। আকাশ জমিন ফেটে মন খারাপ করছে ছেলেটির চোখেমুখে।  


তারপর কাজল টং দোকান থেকে উঠে ধীরেসুস্থে  সেই ছেলেটার কাছে যায় আর ঘাসের উপর বাবু হয়ে বসে । ছেলেটি তখন ভয় ভয় চোখে তাকায় কাজলের দিকে।


কাজল ছেলেটিকে ডেকে বলে, কিরে কি নাম তোর? 

ছেলেটি বলে: হুম আমার নাম? কেন, আমার নাম দিয়া আপনের কি দরকার?


কাজল বলে, আমার একটা ভাই আছে ঠিক তোর মতো, তার নাম রাখব। তাই তোর নামটা জানতে চাইলাম। ভালো লাগলে তোর নামটাই রেখে দিবো।

ছেলেটা বলে, কি-যে কন না ভাই। আইচ্ছা যাক। আমার নাম হইলো জিহান। আগে পরে কিছু নাই, শুধু জিহান। আচ্ছা ভাই, আপনার কাছে ৫টা টাহা অইব? আমাৱে ৫টা টাহা দিবেন?


কাজল: কেনো? ৫ টাকা দিয়া তুই কি করবি? 


জিহান: ভাই, রাইতে কিছু খাইনাই । সকালেও ওই ডাস্টবিনে খাওয়ার মতো কিছু পাইনাই। পেটে অসহ্য খিদা। যদি কিছু খাইতে পারি….. 


কাজল কিছুক্ষণ ভেবে..........টং দোকানের মামাকে ডাকে, মামা; একটা চা আর দুইডা বিস্কিট দিয়ো তো।


আনতেছি মামা।


আচ্ছা জিহান, তোকে তো আমি সকালের নাস্তা করাবো কিন্তু বিনিময়ে তুই আমারে কি দিবি বল?


জিহান বলে আপনি কি চান? আপনার মাথা টিপা দিমু?


কাজল: না আমি একটু জিহানের গল্পটা শুনতে চাই।


জিহানের গল্পের সূচনা ;


একটা মহিলাকে জিহান মা বলে জানত এবং উনাকে মা বলেই ডাকত। কিন্তু তার আসল বাবা-মা কে, জিহান বা সেই মা সেটা জানত না।


হঠাৎ এক সকালে,


তার পালিত মা বলে, আমি তোর আসল মা না, তোর আসল বাবা-মা কে সেটাও আমি জানি না। তোকে আমি এক বৃষ্টি ভেজা রাতে কুঁড়েয়ি পেয়েছি। নবজাতক, গা হাত পা ঠান্ডা, খুব মায়া লেগেছে ফুটফুটে মায়া। তারপর আমার চাঁদরে জড়িয়ে তোকে ঘরে নিয়ে আসি। 


জিহান বলে না, তুমিই আমার মা, আমি এটাই জানি ঐ কথাটি জিহান বিশ্বাস করে না। 


এমনি করে  হঠাৎ একদিন তার পালিত মা মারা যায়। মারা যাওয়ার সময় তার মা তাকে বলে যায়, যদি পারিস তবে তোর নিজের বাবাকে মাকে খুঁজে বের করিস। 


মায়ের সাথে কোনভাবে সুখে দুখে দিন কাটছিলো জিহানের।


কিন্তু শেষ আশ্রয়স্থল তার মা চলে যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়, জিহানের জীবনের মূল ট্রাজেডি। সে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে চলতে থাকে আর তার নিজের মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াতে থাকে। (কারণ মৃত্যুর সময় ঐ মা বলে দিয়েছিল)।


প্রতিনিয়ত না খেয়ে উপোষ থেকে, স্টেশনে স্টেশনে রাত কাটিয়ে, এই নিষ্ঠুর সমাজের সাথে লড়াই করছে জিহান।  


আমাদের সমাজের বিত্তবান, জ্ঞানী লোকেরাই সজোরে লাথি মারছে তার ললাটে। অসহায়  জিহান উপার্জন আর বেঁচে থাকার লক্ষে হন্ন হয়ে কাজ খুঁজে বেড়ায়।

আধ পেটে জিহান এখন রাস্তায় থমকে দাঁড়িয়ে । মানুষের ফেলে দেয়া খাবার-ই জিহানের এখন প্রাত্যহিক আহার। জিহান আশ্রয় পথে ঘাটে। তারপরও অভিযোগের রেশ নেই, দিব্যি চলছে। 


মা'র মৃত্যুর পর কিছুদিনে জিহান খানিকটা বড় হয়েছে। শিশু থেকে পথশিশু হয়েছে। চুল গুলো বেশ উষ্কখুষ্ক, গায়ে হাফ হাতা গা ঝোলানো শার্ট, পরনে মেরু রংয়ের একটি প্যান্ট, এই তার পোশাকআশাক, বাহারি সাজ। 


এক রাতে জিহান গাছের নিচে বসে খুব কাঁদছে, তার মা'র কথা মনে করে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। জিহান বৃষ্টিতেই কাঁদে। বৃষ্টি আর তার কান্না একাকার হয়ে মিশে যায়।  তার চোখের নিষ্পাপ জল এই শহর দেখতে পায় না। আচমকা,  রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো এক ভদ্রলোক। বৃষ্টি দেখে ভদ্র লোক গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়, আশ্রয় নেয়। 


তিনি লক্ষ্য করল, তার পাশে ছোট ছেলেটি খুব কাঁদছে। জিজ্ঞেস করল, তুমি কাঁদছো কেনো? জিহান বললো এমনি। তখন ভদ্রলোক বললেন তুমি কোথাই থাকো? জিহান বলল স্যার আমি এখানেই থাকি। আমার মা-বাবা কেউ নাই।


পর মুহুর্তে জিহানের দু'মুঠো খাওয়ার আর থাকার একটা বন্দোবস্ত হলো। একটা নিশ্চিত আশ্রয় হল ঐ ভদ্রলোকের বাসায়। ভদ্রলোক সেই বৃষ্টির রাতে গাছতলা থেকে জিহানকে তার নিজের বাসায় আশ্রয় দেন। 


সেই ভদ্রলোক শিশুদের নিয়ে একটি সংস্থায় কাজ করেন। গরীব - দরিদ্র শিশুদের সাহায্যে করেন। তাদের পড়াশোনা, তাদের একটি নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ এসব নিয়ে দিনরাত খাটেন।

একজন দারুন সমাজ সেবকও বটে। 


ভদ্রলোকের বাসায় আসার পর জিহানের প্রত্যাহিক রুটিনে খুব নিয়ম এসেছে, কড়া নিয়ম। ঘুম থেকে উঠে ঘর পরিষ্কার করা, ভদ্রলোকের জন্য নাশতা তৈরী করা, ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা, কাপড় কাঁচা এই করেই সকাল থেকে রাত হয় জিহানের।

ভদ্রলোকের আদেশের বাইরে এদিক সেদিক হলেই পিঠে বেত্রঘাত পড়ে। 

সারাক্ষণ জিহান এখন ভয়ে দুমড়েমুচড়ে থাকে। মাঝে মাঝে জিহান ভাবে তাতে কি, দু'মুঠো খেতে আর রাতে শুতে তো পারছি। অল্পতেই জিহান মহাসুখি। 


এক সকালে, জিহানের প্রচন্ড জ্বর। জিহান বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। তাই জিহান ভদ্রলোককে সকালে ঘুম থেকে ডাকতে পারেনি। সেজন্য তার অফিসে যেতে কিঞ্চিত দেরি হয়েছে। খুব জ্বরের মধ্যেও ভদ্রলোক জিহানকে ছাড় দেন নি। প্রচুর মেরেছে। 

জিহান এখন একটু বুঝতে শিখেছে। বিত্তবান লোকদের থেকে খানিকটা বিবেকবান হয়েছে জিহান। তার বিবেক সমাজের ঐ ভদ্রলোকসুলভ  লোকের চেয়েও উত্তম। ভদ্রলোকের করা সংগঠন, শিশুদেরকে নিয়ে লোক দেখানো কাজ খানিকটা কৌতুকরস মনে করছে জিহান। তার মতে, এমন কৌতুক না করাই উত্তম যা নির্মম।


সেদিন জিহান মার খেয়ে পালিয়ে যায় ভদ্রলোকের বাসা থেকে। 

আবার সেই অনিশ্চিত জীবন। আশ্রয় সেই গাছতলায়, তবে এই জীবনে জিহান দিনশেষে খুশি। মনের আনন্দই যে তার দেহের, প্রাণের শক্তির জোগানদার।  জিহান বেঁচে থাকার গান গায়। জিহান এখন লড়াই এর জন্য প্রস্তুত দিনের শুরুতেই। 


কাজল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার চোখের দিকে। জিহানের ঐ নিষ্পলক চোখ দিয়ে অশ্রু বর্ধন হচ্ছে। যা রীতিমত কাজলের হৃদয় শীতল করে দিচ্ছে। কাজল খুব সাধারাণ পরিবারের, মফস্বল শহরে বেড়ে উঠা উঠতি এক তরুন মাত্র। না বিত্তবান, না সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তবে কাজল পথ শিশুদের জন্য একটা সংস্থা তৈরী করেছে তার বন্ধুদের নিয়ে। তারা প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করে, টিউশনির টাকা জমিয়ে এই সংস্থার ব্যয় বহন করে। তারা শিক্ষার আগে চায় পথশিশুদের থাকা-খাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে। তারা, পথশিশুদের নিরক্ষরও রাখতে চায় না। কাজল বলে এই সোনার বাংলা ততদিন সোনায় প্রতিফলিত হবে না যতদিননা বিত্তবানরা জমিতে এসে, শষ্য না ফলাবে। অন্যথায় একদিন এই শষ্য ফুরিয়ে যাবে, আমাদের শহরে ফোটা এই শিশুরাও নিমিষে হারিয়ে যাবে বৃষ্টির ফোঁটার সাথে সাথে। 


কাজলের সাথে জিহানের দিন এখন ভালোই কাটছে। তবুও ঝাপসা হৃদয়ে জিহানের চোখ এখনো তার হারানো বাবা-মা কে খুঁজে। 

অন্যদিকে, কাজল আর তার বন্ধুরা মিলে কাজ করছে পুরোদস্তরে। থেমে থাকার জো নেই তাদের। নতুন কিছু করাই যেনো তাদের ধর্ম। এই কাজলরাই তো আলগোছে আগলে রাখছে হাজারো পথশিশুকে। দু'পায়ে ছেড়াজুতো আর কাঁধে মলাটো ব্যাগ ঝুলিয়ে হেঁটে চলছে তাদের অজানা গন্তব্যের দিকে। 

রমজানে মী-টাইম, উই-টাইম বের করা খুব টাফ ছিলো। রমজানের একটা ব্যস্ততা তো থাকেই তার সাথে সাথে সবার অফিসের কাজের চাপ। সবমিলিয়ে আমরা একসাথে থাকলে...