রবিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২১

প্রতিটা মানুষের জীবনে উদযাপনের জন্য একটি বিশেষ দিন থাকে। 'জন্মদিন' সেই দিনের একদিন। আমার মনে হয়, জন্মদিন আর মা একটি আরেকটির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে । 
আমি জানি, এই দিনে আরিফার নিশ্চয়ই আম্মার কথা মনে পড়ছে। খুব মনে পড়ছে।

বুকের ভেতর কি যে হাহাকার চলছে।
এক অদ্ভুত যন্ত্রণা— মনে পড়ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। কান্নাগুলো জমে জমে মেঘ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বৃষ্টির মতোন ঝড়ে পড়ছে না।

আরিফা,
তোর জন্য—
আমার সবটুকু ভালোবাসা।
আমার সবটুকু বসন্ত। 
আমার সবটুকু মন-খারাপ। 
আমি 'আমাকে' তোর নামে—লিখে দিলাম।
পুরোটা দিলাম—

প্রতিবছর নিয়ম করে 'প্রথম' শুভেচ্ছা জানাতো আম্মা— এইবার না হয় 'আমিই' জানালাম, 'আমরা' জানালাম।

হ্যাপি বার্থডে আরিফা। 
কথা দিলাম, তোকে মাথায় করে রাখবো—যেমনটা আম্মা রাখতো। তোর জন্য লাল টুকটুকে ভালোবাসা।  ♥

২২/১১/২১ 

বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২১

১|

বৃহস্পতিবার। ভোর ৪টা ৩০। নিয়মমাফিক মোবাইলের এলার্মেই ঘুম ভাঙলো। শহরে এখনো ঝাঁকিয়ে শীত না নামলেও হালকা শীতের আমেজ তো বইছেই।  চারিদিকটা তাই হালকা কুয়াশায় আচ্ছন্ন। কুয়াশার বুক ভেদ করে যেন— ফুটে উঠছে আলোর রেখা। মক্তব থেকে কুয়াশায় ভেসে আসছিলো মুয়াজ্জিনের দরদিয়া কণ্ঠে—"আস-সলাতু খাইরুম মিনান নাউম/ আস-সলাতু খাইরুম মিনান নাউম"। সালাত শেষ করলাম। তারপর দ্বিতীয় দফায় আবার ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ক্লাস- সকাল ৯টা ৪০-এ। ভার্সিটির গাড়ি- ৯টা ২০-এ। মোবাইলে এলার্ম সেট করলাম ৮টা ৫০-এ। সময়মত 'ক্রিং ক্রিং' টোনে এলার্ম বেজেই চলছিলো, কিন্তু ঘুম আর ভাঙতে চাচ্ছিলোই না। গড়িমসি করে উঠতে উঠতে ভার্সিটির গাড়ির আর নাগাল পেলাম না। ক্লাসটাও যেন মিস না হয় তাই তড়িঘড়ি করে, টাট্টুঘোড়ার মতো ছুটতে লাগলাম।  

"Research Methodologies & Action Research" এবং "The Literature of Civil Rights" এর পরপর দুটো ক্লাস শেষ করে স্বস্তিতে গাড়িতে চাপলাম। মেইন সড়কে এসে আরেকটা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছি। পিছন থেকে একটা ট্রাক খুব ফাস্ট ছুঁ মেরে আমাদের শরীর ছুঁয়ে গেল। একেবারে গা ঘেঁষে যাওয়া যাকে বলে। আমাদের পজিশন  যদি একটু এদিক সেদিক হতো আজকেই আমাদের নামের আগে 'মৃত অমুক / মৃত তমুক' লাগতে পারতো। কিন্তু সবই তাঁর ইচ্ছে।  আমরা এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছি। আমরা এখনো বেঁচে আছি।

কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলে দেয়া হয়েছে যে, মৃত্যুর জন্য সময় নির্ধারিত রয়েছে। সে সময় উপস্থিত হয়ে গেলে কেউ বাঁচতে পারবে না। আবার যদি সে সময় তখনো না আসে, তা হলে কেউ মরতেও পারবেনা।

এভাবেই নানা জায়গায় বলা হয়েছে, কোনো কষ্ট বা ক্ষতিসাধন করা না করা একান্তভাবেই আল্লাহর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর ইচ্ছা ও হুকুম না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ আমাদেরকে কষ্ট দিতে ও ক্ষতি সাধন করতে পারবেনা। আর যখন তার পক্ষ থেকে হুকুম হবে, তখন কেউ আমাদেরকে কষ্ট ও ক্ষতি থেকে রক্ষাও করতে পারবেনা।

>>সূরা আল ইমরানে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর কারো মৃত্যু আসতে পারে না আল্লাহর হুকুম ব্যতীত। (মৃত্যুর জন্য) নির্ধারিত সময় লেখা হয়ে গেছে।’ (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৪৫)। 

>>অন্য আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘যখন তাদের মৃত্যুকাল উপস্থিত হয়ে যাবে, তখন না এক মুহূর্ত পেছনে থাকতে পারবে, না এগিয়ে যেতে পারবে (ঠিক নির্ধারিত সময়ে তুলে নেয়া হবে)। (সূরা ইউনুস : আয়াত ৪৯)।

২| 

দুপুর ১:৪০। ওই যে ট্রাক এক্সিডেন্টের ঘটনাটি ঘটলো সেই সুবাধে সড়কপথে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আছি। সময় নিচ্ছিলাম, গাড়িতে চড়চ্ছিনা। ছোটো খালার বাসা থেকে পায়ে হেটে মাত্র ৬/৭ মিনিট পথের দূরত্বে অবস্থান করছিলাম। পেটে প্রচণ্ড খিদা। প্রয়োজনীয় কিছু কাজ আছে, বাসায় গিয়ে খাওয়ার সময়ও নাই।  তাই ভাবলাম ডিম চপই হয়তো আজকের দুপুরের খাবার। কিন্তু মনে মনে ছোটো খালার বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার কথাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভাবতে ভাবতেই আচমকা ফোনটা বেজে উঠলো। কাকতালীয়ভাবে ফোনের স্ক্রিনে দেখলাম 'ছোটো খালা'।  কোনো কাজটাজ দিবে ভেবে কলটা ধরিনি।  আবার কল। তারপর আবার কল। অবশেষে ধরলাম। ও-পাশ থেকে বেশ ধমকের সুরেই বলছেন—কিরে ফোন ধরিস না কেন? তুই আশেপাশে থাকলে বাসায় আয়। কাজ আছে। কাজের কথা শুনে মুখ আর মন দুটোই পানসে হয়ে গেল। 

তারপর ভাবলাম, যেহেতু উনার বাসার আশ-পাশেই ঘুরঘুর করছি তারচে বরং চলেই যাই। গেলাম। প্রায় ২টা ৩০ ছুঁইছুঁই। উনার বাসায়, কবজি ডুবিয়ে হাঁসের মাংস আর পোলাও খেলাম। সাথে মাখানো সালাদ। আমার খুব প্রিয়। দুপুরে খাবারটা ডিম চপ থেকে হাঁসের মাংস। তারপর ৩০/৪০ মিনিটের একটা শান্তির বিশ্রাম শেষ করে, বের হয়ে পড়লাম নিজের কাজে। 

দ্যাখেন, আমি আগামি  দশ বছরে কত টাকা আয় করবো বা আগামি দশ বছরে কি কি খাবার কতটুকু খাবো— সব কিছুই এক আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। সকলের রিযিকের মালিক তিনিই। কারো রিযিক কমানো-বাড়ানো বা জুতসই করা সবই তাঁর এখতিয়ার। সারা দুনিয়ার মানুষ মিলেও যদি আপনার বা আমার রিযিক বন্ধ করতে চায় কিন্তু আল্লাহ না চাইলে কেউ পারবে না আবার আল্লাহ রিযিক দিতে না চাইলে সারা দুনিয়ার মানুষ মিলেও আপনাকে বা আমাকে এক লোকমা খাবার খাওয়াতে পারবে না। তিনি আমাদের জন্য যতটুকু নির্ধারণ করে রেখেছেন, ঠিক ততটুকুই কেবল আমরা ভোগ করতে পারি বা পারব। খুব স্মুথলী।

কুরআনের অনেক সূরায় রিযিক সম্পর্কে বলা 
হয়েছে—

>>আল্লাহ পাক উত্তম রিযিকদাতা। (সুরা জুমা : ১১)। 

>>নিশ্চয় আল্লাহ পাকই রিযিকদাতা। (সুরা জারিয়াত : ৫৮)। 

>>পৃথিবীতে বিচরণকারী প্রত্যেকটি প্রাণীর জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ পাক নিজেই গ্রহণ করেছেন। (সুরা হুদ : ৬)। 

>>আল্লাহ পাকই তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা রিযিক বাড়িয়ে দেন এবং যাকে ইচ্ছা তাঁর রিযিক সীমিত করেন। নিশ্চয় আল্লাহ পাক সব বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত। (সুরা আনকাবুত : ৬২)।

-------------------------------------------

আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই আমাদের হায়াত-মউতের মালিক। তিনিই আমাদের রিযিকদাতা। শুধু রিযিকদাতা নয়; উত্তম রিযিকদাতা। এবং তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারি। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে তিনি আছেন, শুধু কি আছেন?—সবটুকু দিয়ে আছেন। এযাবৎ আমার সাথে যা যা ঘটেছে সবকিছুই ভালো ঘটেছে ; বরঞ্চ বলতে হয়—'সর্বোচ্চ ভালোটাই' ঘটেছে। 
আলহামদুলিল্লাহ। মাআসসালাম। 

আঠারো  | এগারো |

মঙ্গলবার, ২ নভেম্বর, ২০২১

আম্মা, আমার মিঠাগদ্য—


সেদিনকার সন্ধ্যার আলাপ—
ফ্লোরে সবাই বসে বসে এটা-ওটা আলাপ করে যাচ্ছিল, আর আমি খাটে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বেমালুম পড়ে আছি। মাঝেমধ্যে হু-হা করে আড্ডায় নিজেকে শামিলও রাখছি।

হঠাৎ সায়মা বলে উঠল,
আপা— এবার সামনের ঘরের পুরোনা খাটটা ভেঙে ফেলব। এই খাটটা বেশ নড়বড়ে হয়ে গেছে। এমাসেই এখানের জন্য নতুন একটা খাট কিনব।

আমার বুকটা মড়মড় করে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। চোখের পানিটা লুকাতে লুকাতে, দুই হাত দিয়ে খাটটাকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছিলাম—শক্ত করে।

ফজরের নামাজের পর আম্মা এই খাটের কোনে বসত। এই খাটেই জায়নামাজ বিছিয়ে আম্মা নামাজ পড়ত আর মনভরে আমাদের জন্য মঙ্গল প্রার্থনা করত।
প্রায়ই ঠিক দুপুরে, মাথার উপরে হাইস্পিড পাখা চলছে, আম্মা তার ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে এই খাটে কিছুক্ষণ বসত আর বলত— আহ শান্তি!

সামনের রুমে এই খাটটিতে আমরা তিন বোন মিলে-ঝিলে ঘুমাতাম। এই খাটটি বেসিক্যালি আমাদের তিন বোনেরই। আম্মা প্রায়ই গল্প করতেন, এই খাটটির বয়স আর আমার বয়স নাকি সেইম-সেইম।
কিন্তু আম্মার চলে যাওয়ার মাস খানেক আগে থেকে আম্মা নিয়মিত আমাদের সাথে এই খাটে ঘুমাতে শুরু করেন।
তার আগে,
আম্মা নিজের রুমে ঘুমাতেন যার ফলে—আমি তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় খুব একটা দেখতাম না। তবে সেইসময় আমাদের সাথে থাকার ফলপ্রসূ আমি রোজ আম্মাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছি। আমি চোখের সামনে আমার জান্নাত দেখতাম। প্রাইসলেস দৃশ্য!

সারাদিনের প্রাণচঞ্চল মানুষটা কত শান্তির, সহজ ঘুম ঘুমাচ্ছেন—
কি মুগ্ধতা আহ! আমার কলজের মাঝে গোটাগোটা হরফে আঁকা সেই দৃশ্যকাব্য।

সায়মাকে বলতে ইচ্ছে করছে—আমাদের সামনের ঘরের খাটটি ভাঙ্গিস না প্লিজ। এই খাটটি আমাদের সাথে বুড়ো হোক। পঁচে গলে যাক। তারপরও রেখে দিস—

এই খাটে এখনো রোজ যখন উপুড় হয়ে শুই— মনে হয় আমি আমার আম্মার বুঁকে শুয়ে আছি। আমিতো এটুকু নিয়েই বাঁচি।

আম্মা যেদিন চলে যাবেন, সেদিন সক্কালবেলা কবুতরের স্যুপ খাওয়ালাম নিজ হাতে, এই খাটেই বসে। আব্বাকে বললাম রাতের জন্য ইলিশ আইনেন। রাতে আম্মাকে ইলিশ দিয়ে ভাত খাওয়াবো। মাগরিবে আম্মার জানাজা হলো।

এখন—আমাদের বাসায় ইলিশ আসে, কিন্তু আমাদের আম্মা আর আসে না।

আম্মার খুউব পেট ব্যাথা হলে যে বালিশ টা পেটে চেপে ধরে ঘুমাতো, সেই বালিশটা থেকে আমি একটি প্যাচপেচে মালিশের তেলের গন্ধ পাই। আম্মা পেটে যে তেলটা মালিশ করতেন এটি—সেটিরই গন্ধ। আমি বালিশটা না ধুয়ে রেখে দিছি আলমারিতে। সময়ে-অসময়ে বের করে আমার পেটের সাথে লাগিয়ে রাখি। আম্মার গায়ের ঘ্রাণ পাই। জান্নাতি ঘ্রাণ।
আমার আম্মা—আমি যেন দম আটকে মরে না যাই তার জন্য কত কিছু রেখে গেছে। আমি এখনো তাই বেঁচে আছি। হাপিয়ে পড়ি না এক মুহূর্তের জন্যেও।

আম্মা, দেখেন—
আপনার বড়কন্যা কত নরম। শিমুল তুলার মতো নরম। তুলতুলে। আপনারে নিয়া কিরকম মিঠাগদ্য লিখে। আপনাকে কদমবুসি, আম্মা।

২/১১/২০২১ইং

রমজানে মী-টাইম, উই-টাইম বের করা খুব টাফ ছিলো। রমজানের একটা ব্যস্ততা তো থাকেই তার সাথে সাথে সবার অফিসের কাজের চাপ। সবমিলিয়ে আমরা একসাথে থাকলে...