সোমবার, ২ মে, ২০২২

রমজানে মী-টাইম, উই-টাইম বের করা খুব টাফ ছিলো। রমজানের একটা ব্যস্ততা তো থাকেই তার সাথে সাথে সবার অফিসের কাজের চাপ। সবমিলিয়ে আমরা একসাথে থাকলেও ছিলাম না থাকার মতোই। রোজ দেখা হতো, ইফতারে টুকটাক আলাপ হতো কিন্তু জম্পেশ গল্প হতো না। যেটাকে সবাই খুব মিস করছিলাম। 

বাইশ রমজানে আমার স্কুল ছুটি হলো, ছোটোদের স্কুল-কলেজ সাথে ভাইয়াদের অফিসও। একটা ভ্যাকেশন আসলো। প্রতিটা মুহুর্ত কাটালাম একসাথে।  আমরা ছোটো থেকেই একজন আরেকজনের পছন্দকে প্রাধান্য দেই। সেই মোতাবেক একসাথে দল বেঁধে কেনাকাটা করেছি। ঘুরেছি। রাতের শহর দেখেছি। মানুষের আনন্দ দেখেছি। উদযাপনের প্রস্তুতি দেখেছি। একরাশ উৎসব যেন মৌ-মৌ করে ঘিরে ধরেছে আমাদের। আমরা সব ভাই-বোনরা যখন খুব আনন্দে থাকি, জড়াজড়ি করে থাকি বড়োআম্মুদের চোখেমুখে খুশির ফোয়ারা দেখতে পাই। আমাদের আনন্দই যেনো উনাদের তৃপ্তি।

আমরা গল্প করি রেনডমলি। টং এর দোকানে বসে চায়ের কাপে যেভাবে মুরব্বিয়ানরা ঝড় তুলে রাজনৈতিক আলাপ থেকে শুরু করে ক্রিকেট, ক্রিকেট থেকে শুরু করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি নিয়ে, আমাদের আড্ডাটাও খানিকটা তেমন। আমরা বলি, পৃথিবীর সব আড্ডাই যে শিক্ষণীয় হতে হবে তার কোনো মানে হয় না। আমরা খোশমেজাজে হেসেখেলে কথা বলি, কথা শুনি। আমরা একসাথে সময় কাটাচ্ছি, নিজেদের ভাগ করে নিচ্ছি আমাদের কাছে এটাই ইম্পরট্যান্ট। পয়েন্ট টু বি নোটেট আমরা একা না, আমরা একসাথে আছি। ইটস এ্যা আলটিমেট ম্যাজিক্যাল থিঙক আমাদের কাছে।  

তারাবির পর, গত পরশুরাতে সবাই একসাথে নুহাশ হুমায়ুনের 'পেট কাটা— ষ' সিরিজটা দেখলাম। কি দারুন কনসেপ্ট! কি দারুন এক্সিকিউশন! এটা দেখার বিশেষ কারন গল্পগুলো একেবারেই আমাদের। আমাদের চিরচেনা মিথের গল্প। আমাদের শৈশবের গল্প।আমাদের শেকড়ের গল্প। যে গল্পগুলোর সাথে মিশে আছে আমাদের মায়েরা, আমাদের দাদিরা। এমন একটা হরর সিরিজ সব ভাই-বোন একসাথে বসে দেখাটাই হ্যাপীনেস ছিলো আমাদের কাছে। 

আজ চাঁনরাত। এই রাতে বেসিক্যালি আমরা ঘুমাই না। কেউ ঘুণাক্ষরে ঘুমালেও নানা যন্ত্রনায় জোর করে তাকে জাগিয়ে রাখা হয়। এসব মিষ্টি অত্যাচার ভালোবাসার, মায়ার, একসাথে জেগে থাকার, স্মৃতিভান্ডার মজবুত করার। সারারাত একেক টপিকে খোশগল্পে মেতে থাকি। প্রতিটা রুমে মানুষে মানুষে গিজগিজ করে। সব আপনা মানুষ। সবাই সবার কথা ভাগাভাগি করে। টিভি দেখে। নিউজ দেখে। লো সাউন্ডে বাজতে থাকে আপামর বাঙালির মননে গেঁথে যাওয়া সেই গান— ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ। চাঁনরাতে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ডিপার্টমেন্ট রন্ধনশালা। এটা থাকে সবচে জমজমাট। সমানে মশলাপাতির প্রস্তুতি চলে, মায়েরা কালকের জন্য কি করবে না করবে তার জন্য ছোটো ছোটো সভারও আয়োজন করেন। রন্ধনশালার রাজত্ব একেবারেই উনাদের হাতে। পাঁচফোড়ন হয়ে আমাদের প্রবেশ করবার কোনো জো নেই। 

অন্যদিকে, আমরা এত্তোগুলা ভাই-বোন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকি না। ছোটো থেকেই জড়াজড়ি করে থাকাটাই আমাদের অভ্যাস। এক বিছানায় শুয়ে বসে কাটিয়ে দেই। সত্যি বলতে এমন চাঁনরাত উদযাপনই— আমাদের ঈদ, আমাদের আনন্দ। আমরা এখনো বড়ো হইনি, বুড়ো হইনি। ঈদ আমাদের কাছে এখনো আনন্দের। আমাদের মধ্যে  ঈদের আনন্দ এখনো নিরানন্দ হয়ে আসে নি। সেই ছোটোবেলার মতো একই আগ্রহ কাজ করে। আমরা এখনো দুরন্ত। আমরা এখনো উল্লাসপ্রিয়। আমাদের শৈশব এখনো প্রাণবন্ত, জীবিত। মাঝেমধ্যে আমরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলি— হাউ লাকি উই অ্যার! 

ঈদ মুবারক। 
দুই । পাঁচ । দুই হাজার বাইশ ।

মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০২২

শবে মে'রাজের রাত নিয়ে ইবাদত বন্দেগির পাশাপাশি কিছু কৃষ্টি কালচারও আমাদের পরিবারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমাদের ছোটোবেলা থেকেই আমরা দেখে আসছি শবে মে'রাজ আসবে আসবে সময় থেকেই আমাদের পরিবারে একটা পবিত্রতার শীতল হাওয়া বইতে থাকে। ছোটো থেকে বড়ো সব সদস্যদের অন্তরালে শবে মে'রাজ উদ্‌যাপনের ব্যাপক তোড়জোড় চলতে দেখি। আমরা বছরে নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন সর্বোচ্চ ভালো পোশাক পড়ার চেষ্টা করি, তারমধ্যে শবে মে'রাজের রাত একটি। সবচে ভালো জামাটা ধুয়ে আম্মা নতুনের মতো করে রাখতেন আর আমরা সেটি পড়ে নামাজ পড়তাম। 

শবে মে'রাজের দিন সকাল থেকেই বাসায় একটা সেলিব্রেশনের আমেজ ক্রিয়েট হয়। যে বছর যতটুকু সামর্থ্য হয় ঠিক ততটুকু দিয়েই ভালো-মন্দ খাবার দাবারের আয়োজন করা হয়। শবে মে'রাজ যে খুউব বিশেষ এটি আমরা ছোটো বয়স থেকেই পরিবারের উদ্‌যাপনের আমেজ দেখে বুঝতে পারতাম। 

সব শবে মে'রাজের রাতেই— এশারের পর নফল নামাজ আদায় শেষে, আমরা সবাই গোল করে বসি। বাড়ির বাচ্চারা একে একে নাতে মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করে। চারিদিক থেকে মারহাবা মারহাবা বলে— আমরা তাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দেই। তারপর পরিবারের সবচে বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ— মে'রাজ গমনের বর্ণনা করে। প্রায় দেড়/দুই ঘন্টা ধরে চলে এই আলোচনা। প্রতিবছর একই ঘটনা, একই বর্ণনা কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ভোকালে আমরা আমাদের মতো করে নতুনভাবে এটার স্বাদ গ্রহণ করি। এখন অবশ্য মাঝেমধ্যে আমাকেও সুযোগ দেয় কিছু বলতে। যার জন্য আমি বিশেষ প্রস্তুতিও নিয়ে রাখি। আলোচনার ফাঁকফুকুরে শ্রোতাদের মুখের দিকে তাকাই, আর দেখি— আমি যতই মে'রাজ গমনের বর্ণানার দিকে আগাই তাদের চোখমুখ ততই রোমাঞ্চিত হয় ওঠে।  

স্বভাবত আমরা আমাদের বিশেষ দিনগুলা পরিবার নিয়ে আষ্ঠেপৃষ্টে জড়াজড়ি করে উদযাপন করি। মুরব্বী কিসিমের সদস্যরা তাদের শৈশবের মে'রাজ কেমন ছিলো, গ্রামকেন্দ্রিক মে'রাজ কিভাবে উদ্‌যাপন হয় এসব স্মৃতি অনর্গলভাবে আওরাতে থাকেন। সেহেরির কিছু আগে— পাড়ার মসজিদ থেকে ইমাম সাহেবের সুরেলা কন্ঠে ভেসে আসে, "আসমানোহি পর সব নবী রাহ গেয়ে, আরশ আযমপে পৌঁহছা হামারা নবী...........ছবছে আওলা ও আলা, হামারা নবী, ছবছে বালা ও আলা, হামারা নবী" আমরা সবে সুরে সুর মিলাই। গাইতে থাকি। 

এভাবেই আমরা হৈ-হৈ রৈ-রৈ করে মে'রাজ উদ্‌যাপন করি। সারারাত জেগে থাকি। আমার এতটুকু বয়সে আমি কোনোদিন একটা নিরানন্দ মে'রাজের রাত দেখিনি। ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি, আমাদের মে'রাজ রজনী খুব উৎসবমুখর। আলোকিত। জ্বলমলে। আজ-ও আমরা খুব দরদ নিয়ে এই দিনগুলা উদ্‌যাপন করি, আয়োজন করি। আমাদের এই দিনের, এই রাতের সেলিব্রেশন নিয়ে বিশেষ এক 'আল্লাদ' আছে। 

১ মার্চ, ২০২২ইং। 
শবে মে'রাজ রজনী।

শনিবার, ১ জানুয়ারী, ২০২২

রোজনামা— ০১

একটা বছর যায় আর— আমি ক্রমশ পৃথিবীর আদিমতম কেউ হয়ে উঠি। আমার সাথে সাথে একটা ঐতিহ্য, একটা ইতিহাস বাড়তে থাকে— বৃদ্ধ হয়। দিস্তা-দিস্তা নতুন সংযোজন হতে থাকে। পুরোনো অনেক কিছুকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। 
একটা মফস্বল হারিয়ে ফেলে তার নিজের গতিপথ। একা— এক সময় স-ব পুরোনো মিলিয়ে যায় বাতাসের সাথে। সেই—সব কিছুর রাজসাক্ষী হয়ে বেড়ে উঠছি আমি। আমার আগামীর কাছে— আমি আদিম মানুষে রুপ নিচ্ছি।

দুই হাজার-কুড়িতে যেই শূন্যতা আমাকে পেয়ে বসেছে— সেই শূন্যতা কোনো বছরের পূর্ণতা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব না। শূন্যতা শূন্যতাই। বেদনার যেমন কোনো রঙ হয় না—শূন্যতারও না। তবুও— সব কিছু ছাপিয়ে বলতে হয়, একুশ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে— বরঞ্চ, দু'হাত ভরে দিয়েছে। সবচে বড়ো কথা একুশ আমাকে আচমকা বড়ো করেছে। আম্মার বিয়োগে— ঘরের ছাদ ফুড়ে আকাশ স্পর্শ করার মতোন বড়ো করেছে। 

একুশের এই যাত্রায়— অনেকের সাথে আলাপ হয়েছে, কাজ হয়েছে। অজস্র পরিপূর্ণতা আমাকে ছুঁয়েছে। কৃতজ্ঞতায় আমার রুহ গলে যায়— গদগদ হয়ে ওঠে।

দিনশেষে আমিও কাঠগড়ায়। দীর্ঘতম শ্বাস নিয়ে বলতে হয়— মানুষ তো! গালগল্পে— নিজেকে মাটির মানুষ হিসাবে চর্চা করতে করতে, চোখ তো কখনো কখনো অহংবোধের সাথে কথার ফুলঝুরি ছিটায়। আমার করা সেইসব অহংবোধ— যদি কারোর কোনো দুঃখের কারন হয়ে থাকে; তবে ক্ষমা চাই। 

'বাইশ' আমার জীবনে একুশের মতোই হুল্লোড়ে থাকুক। পূর্ণতায় থাকুক। মায়াতে থাকুক। আমার প্রতিটা নতুন বছর যেনো কেবল সংখ্যা বদলে আসে— একুশের আদলেই। এটাই চাওয়া। আপনারা  আমাকে মঙ্গল কামনায় রাখবেন। 

উঠোন জুড়ে মিঠাদুপুর— ভাবি; আমার— এখনো কত সকাল দেখা বাকি, এখনো কত রাত নামে নি। এখনো কত দুঃখ ছোঁয় নি আমায়, এখনো কত সুখের তৃপ্তি— অনাদায়ী। 

সবাই কে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। অনেক অনেক শুভেচ্ছা। 
ফজরে মুয়াজ্জিনের দরদমাখা কন্ঠ, অলসদুপুর, ট্রাফিকজ্যাম, মাগরিবের নীরবতা— সব কিছু ছুঁয়ে যাক আপনাকে; আমাকে। যা কিছু ভুল— ভুলে যান। নতুন করে মরমি মোলাকাত দিয়ে শুরু করেন পুরানো ধাঁচের নতুন হালখাতা। 🌿

শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১

চোখের— সামান্য সুখের জন্য কয়েক মুহূর্ত আগুন উড়ানোর উৎসব চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ করে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা করার পরও আমরা ব্যর্থ— শব্দবাজির দাপটের কাছে। 
নিয়মমাফিক, অনিয়ম 'বরদাস্ত' করা দিয়েই শুরু হয় আমাদের প্রতিটা বছর। আমরা কেবল সহনশীল জাতি প্রমাণর্থে দাবিয়ে রাখি— আমাদের রুহের ভেতরকার আলাপকে। হায়! রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি? রাত পোহাবার আর কত দেরি পাঞ্জেরি? 

এক । এক । বাইশ ।

বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১

বই: বিশ্বনবী। 
লেখক: গোলাম মোস্তফা।
প্রকাশনী: আহমদ পাবলিশিং হাউস।
প্রকাশক: মেজবাহউদ্দীন আহমদ।
প্রচ্ছদ: আমানউল্লাহ।
বর্ণবিন্যাস: ইয়াশা কম্পিউটার।
প্রথম সংস্করণ: অক্টোবর ১৯৪২
মুদ্রিত মূল্য: ৪০০ টাকা মাত্র
পৃষ্ঠা: ৪৭২


_______________________________

একই জীবন, একই কাহিনী, একই চিন্তা, একই কর্মধারা। সে একই কথা—বহুমুখে, বহুজনে, বহুশতাব্দী ধরে বাতাসে-বাতাসে ফিরছে, তবু যেন অফুরান—যেন কিছু লেখা হলো আর অলিখিত রয়ে গেল ঢের। কিছু বলা হলো আর অনেক কিছুই হয়নি বলা। এ চর্চাক্ষেত্র বারবার কেন জানি অপূর্ণ রয়ে যায়। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মত শেষ হইয়াও হইলো না শেষ—

এ যাবৎ অবধি— মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে অসংখ্য জীবনীগ্রন্থ লেখা হয়েছে। একেবারে প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত বহুলেখক, সাহিত্যবিশারদ, গবেষক এবং অনেক কবিদের হাতে হয়েছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান জীবনের চর্চা। এই চর্চা কখনো হয়েছে আরবী ভাষায় আবার কখনো অনারব ভাষায়ও। উর্দু ভাষায়, ফার্সি ভাষায়, আরবি ভাষায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনীগ্রন্থের অভাব নেই। তবে সেই তুলনায় আমাদের বাংলা ভাষায় এর ব্যাপকতা খুবই কম। 

বাংলা সাহিত্যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন শেখ আবদুর রহীম। তারপর তাঁর সিরাত নিয়ে রচনা করার কাতারে এসেছে আরো বহুনাম, আরো বহুসাহিত্যিক। তারমধ্য কবি 'গোলাম মোস্তফা' একজন। তার সৃষ্টি 'বিশ্বনবী'। তাঁর  সীরাত সাহিত্যের এই 'সৃষ্টির' পরতে পরতে শিহরণ ও ছত্রে ছত্রে সাহিত্যরসের হিমশীতল সমীরণ। ভাষার মাধুর্য, মুগ্ধকর বর্ণনা, সুনিপুণ উপস্থাপনা, মননশীল শৈলী ও চিত্রায়ন—গ্রন্থটিকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

আমার মনে পড়ে, ছেলেবেলায় কবি 'গোলাম মোস্তফা'র প্রার্থনা কবিতা দিয়ে তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের কথা।  
কবিতায় তিনি বলেছেন—
"দ্যুলোক-ভূলোক সবারে ছাড়িয়া
তোমারি চরণে পড়ি লুটাইয়া
তোমারি সকাশে যাচি হে শকতি
তোমারি করুণাকামী"
সেই ছেলেবেলায়—সেই প্রাথমিকে, কি নিদারুণ শব্দে তিনি আমাদের রবকে চিনিয়েছেন।
প্রার্থনা কবিতা দিয়ে শুরু হলেও তারপর গোলাম মোস্তাফার সৃষ্টির সবকিছুই কমবেশি পড়ার চেষ্টা করেছি। সাম্প্রতিক সময়ে পড়লাম তাঁর রচিত জীবনীগ্রন্থ 'বিশ্বনবী'। আজ সেই গ্রন্থটি নিয়েই আলাপ করবো, ইনশাআল্লাহ। 

১৯৪২ সালে চুঁচুড়া থেকে কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’ প্রকাশিত হয়। গোলাম মোস্তফা (জন্ম: ১৮৯৭ - মৃত্যু: ১৩ অক্টোবর ১৯৬৪), একজন বাঙালি লেখক এবং কবি। তাঁর কাব্যের মূল বিষয় ছিল ইসলাম ও প্রেম। মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত কবি গোলাম মোস্তফার অবদান বাংলা সাহিত্যে এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর রচিত ‘বিশ্বনবী’ একটি আশ্চর্য রকমের সফল সৃষ্টি। এই অমর গ্রন্থখানি গদ্যে রচিত হলেও সে গদ্যও—কবিতার মত ছন্দময় এবং মধুর। গ্রন্থখানা বিশ্বনবী হয়রত মুহম্মদ এর একটি সার্থক জীবন চরিত। গ্রন্থটিতে হৃদয়ের আবেগ, আন্তরিক অনুভূতি যে ভাবে বর্ণিত হয়েছে তার তুলনা আমাদের বাংলা সাহিত্যে নিতান্তই বিরল।
আমি মনে করি, এই বইটাকে শুধু একটা জীবনীগ্রন্থ বললে ভুল হলা হবে। কারন, এর দার্শনিক বিবৃতিকে অস্বীকার করবার জো নেই। নবীজীর জীবনের বিভিন্ন দিক পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ধরে আমার মনে হয়না আগে কেউ এভাবে আলোচনা করেছেন। বইটির প্রথম খন্ডে মোট ৫৮টি ও দ্বিতীয় খন্ডে মোট ১৪ টি পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিটি পরিচ্ছেদের আলোচনা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত, হৃদয়গ্রাহী ও প্রাঞ্জল। শব্দের সাথে শব্দের সখ্যতা, সাবলীল উপস্থাপন, বাক্যালাপের সুনিপুণ গাঁথুনি—সব মিলিয়ে আদ্যপ্রান্ত গ্রন্থটিই আমার অন্তরের খুব কাছের। আমার প্রিয় পাঠের সর্বোচ্চ চূড়ায় থাকবে এই গ্রন্থটির নাম।
তবে মনে রাখতে হবে, 'বিশ্বনবী' নিঃসন্দেহে একটি গবেষণাগ্রন্থ, সর্বসাধারণের বোধগম্যও। এর কোন আলোচনা যুক্তির ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েনি, আবার আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন অযৌক্তিক কিছুকে প্রশ্রয়ও দেয়া হয়নি। 

গ্রন্থটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত অথচ মোটাদাগে একটা ধারণা পেতে পারেন—সেই সুবাদে নিম্নে সূচিপত্রটি উল্লেখ করলাম। 

সূচিপত্র—

প্রথম খণ্ড
* আমিনার কোলে
* কোন আলোকে
* প্রতিশ্রুতি পয়গম্বর
* বংশ পরিচয়
* নামকরণ
* সমসাময়িক পৃথিবী
* শিশুনবী
* প্রকৃতির কোলে
* বক্ষ-বিদারণ
* শিশুনবী এতিম হইলেন
* সিরিয়া ভ্রমণ
* আল-আমিন
* শাদী মুবারক
* কাবাগৃহের সংস্কার
* গৃহীর বেশে
* সত্যের প্রথম প্রকাশ
* সত্যের স্বরূপ
* সত্য প্রচারের আদেশ
* সত্যের প্রথম প্রচার
* প্রথম তিন বৎসর
* সংঘর্ষের সূচনা
* উৎপীড়ন
* এ আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে
* প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল
* সাহারাতে ‘ফুটলরে ফুল’
* অন্তরীণ বেশে
* সর্বহারা
* তায়েফ গমন
* আল মি’রাজ
* অন্ধকারের অন্তরালে
* হিযরতের পূর্বাভাস
* শিষ্যদিগের প্রস্থান
* হিযরত
* আল-মদিনায়
* প্রেমের বন্ধন
* ইসলামিক রাষ্ট্র রচনা
* মদিনার আকাশে কালো মেঘ
* বদর-যুদ্ধ
* বদর-যুদ্ধের পরে
* ওহদ যুদ্ধ
* জয় না পরাজয়
* ওহদ যুদ্ধের শেষে
* চতুর্থ ও পঞ্চম হিযরীর কয়েকটি ঘটনা
* আয়েশার চরিত্রে কলঙ্ক-দান
* খন্দক যুদ্ধ
* ষষ্ঠ হিযরীর কয়েকটি ঘটনা
* হোদায়বিয়ার সন্ধি
* দিকে দিকে গেল আহবান
* খায়বার বিজয়
* মুলতবী হজ
* মুতা-অভিযান
* মক্কা বিজয়
* মক্কা-বিজয়ের পরে
* হোনায়েন ও তায়েফ অভিযান
* তাবুক অভিযান ও অন্যান্য ঘটনা
* বিদায় হজ
* পরপারের আহবান
* শেষ কথা

দ্বিতীয় খণ্ড
* পূ্র্বাভাষ
* হযরত মুহাম্মদ জন্ম তারিখ কবে
* কাবা শরীফ কখন নির্মিত হইয়াছিল
* ইসলাম ও পৌত্তলিকতা
* ইসলাম ও মো’জেজা
* স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক
* বিজ্ঞান আজ কোন পথে
* ইসলাম ও নূতন বিজ্ঞান
* মি’রাজ
* থিওসফী ও মি’রাজ
* ‘মুহম্মদ’ ও ‘আহমদ’ নাম কি সার্থক হইয়াছে
* মুহম্মদ ‘মুহম্মদ’ ছিলেন কিনা
* হযরতের বহু বিবাহের তাৎপর্য
* মুহম্মদ ‘আহ্‌মদ’ ছিলেন কি-না

সত্যি বলতে—মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই বইটিকে অসাধারণ জনপ্রিয় করে তুলেছে। 'বিশ্বনবী' সম্বন্ধে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অভিমত— “মৌলভী গোলাম মোস্তফা কবিররূপে সুপরিচিত। তাঁহার নব অবদান ‘বিশ্বনবী'। বলা বাহুল্য, ইহা ‘বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদের (সঃ) একটি সুচিন্তিত প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠাব্যাপী জীবনচরিত। এই গ্রন্থকার আঁ-হযরত সম্বন্ধে তাঁহার দীর্ঘকালের গভীর চিন্তা ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিচয় দিয়াছেন। আমরা এই পুস্তকখানিতে গোলাম মোস্তফা সাহেবকে একজন মোস্তফা-ভক্ত দার্শনিক ও ভাবুকরূপে পাইয়া বিস্মিত ও মুগ্ধ হইয়াছি । ভাষা, তথ্য ও দার্শনিকতার দিক হইতে গ্রন্থখানি অতুলনীয় হইয়াছে।”
অন্যদিকে, শ‍্রী মনোজ বসু বলেছেন— “মহানবীর পরমাশ্চর্য বৃত্তান্ত লেখার সময় আপনার কবি ধর্ম সর্বদা আপনাকে গণ্ডিসংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে রেখেছে। আমি ও আমার মত আরও অনেকে ধর্মে মুসলমান না হয়েও হযরতকে একান্ত আপনার বলে অনুভব করতে পেরেছি। ভাষা, কবিত্বঝঙ্কার ও ভাব—লালিত‍্যে বইটি অপরূপ মহিমা লাভ করেছে।”
আবার, ফুরফুরা শরীফের পীর মাওলানা আবু নসর মুহম্মদ বলেন—“যাঁহারা বাংলা ভাষায় হযরত রসূলে করীমের (সঃ) সঠিক জীবনী ও সত‍্যরূপ জানিতে চান, তাহাদিগের ‘বিশ্বনবী’ পাঠ করিতে অনুরোধ করি।"

কবি বইটি গদ্য দিয়ে শুরু করলেও শেষ করছেন পদ্য দিয়েই। শেষ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন—

তুমি যে নূরের রবি
নিখিলের ধ্যানের ছবি
তুমি না এলে দুনিয়ায়
আঁধারে ডুবিত সবি।
নবী না হয় দুনিয়ায়
না হয়ে ফেরেশতা খোদার
হয়েছি উম্মত তোমার
তার তরে শোকর হাজার বার!

মরুভাস্কর নবীর প্রতি লেখকের ভক্তির সুরভি দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে—
‘বিশ্বনবী’ রচনায় কবি গোলাম মোস্তফা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যে শ্রদ্ধা, ভালবাসা, হৃদয়াবেগ, অনুরাগ, ভক্তি ও নবীপ্রেমের আন্তরিক ভাবোচ্ছ্বাসের তরঙ্গময় প্রকাশ ঘটিয়েছেন; তার ফলে, কবির গোলাম মোস্তফা (নবীর ভৃত্য/গোলাম) নামটি যথার্থ ও স্বার্থক হয়েছে। 

গ্রন্থটিতে নেতিবাচক কিছু বিষয় থাকলেও আজকের আলোচনায় আর টানছি না। তবে, উত্তরসমেত একটি প্রশ্ন নিম্নে আপনাদের নিকট পেশ করছি। 
প্রথমত বলি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেনো জানতে হবে আর জানার জন্য গোলাম মোস্তাফার 'বিশ্বনবী' বইটিই বা কেন পড়তে হবে? 
উত্তর: দুনিয়াতে আমাদের জীবনযাপনে, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের প্রতিটি অঙ্গনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের জন্য উত্তম ও অনুপম আদর্শ। এই কথাটি অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। এ কারণে এমনিতেই তাঁর(মুহাম্মদ) জীবনী পাঠ করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য একান্ত কর্তব্য। 
অবশ্যপাঠ্য এই জীবনীগ্রন্থ যদি রচিত হয় সাহিত্যসমৃদ্ধ ভাবাবেগপূর্ণ ভাষায়, তা হলে তা হয়ে উঠে সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য বাড়তি আনন্দ ও খুশির কারণ। বক্ষ্যমাণ বইটির সাহিত্যমান সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা পেতে বাংলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক সৈয়দ আলী আহসানের মন্তব্যটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। বইটির মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি কি বলছেন; পড়ুন—“বাংলা সীরৎ গ্রন্থগুলির মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী যেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে অন্য কোনোটির ভাগ্যে তা হয় নি। এর ভাব যেমন উচ্চস্তরের, ভাষাও তেমনি প্রাঞ্জল, গতিশীল ও ওজস্বিনী। কবি গোলাম মুস্তফা একাধারে সুনিপুণ বাকশিল্পী, কবি ও ভক্ত। তাই তার আন্তরিকতাপূর্ণ ভক্তির ভাবোচ্ছ্বাস ও কাব্যের লালিত্য গ্রন্থটিকে সুষমামণ্ডিত করেছে। তার ভাব ও ভাষায় ভক্তিপ্রবণ বাঙালি অন্তরের মর্মকথাই কাব্যের ললিত রচনায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ভক্ত প্রেমিকের মধুঢালা রচনাবিন্যাস বইটিকে অসাধারণ জনপ্রিয়তার অধিকারী করেছে।”

গোলাম মোস্তাফার ‘বিশ্বনবী’র যে কোনো পাঠক সৈয়দ আলী আহসানের কথার সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করবেন বলে আমার বিশ্বাস। তাই সাহিত্যরস আহরণ ও আস্বাদনে প্রয়াসী হবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে নববী আদর্শের উজ্জীবন ঘটাতে আগ্রহী প্রতিটি ব্যক্তিকেই আমি মনোহর প্রচ্ছদ ও ঝকঝকে ছাপার কালজয়ী এই বইটি সংগ্রহ করে পাঠ করার জন্য বিনম্র পরামর্শ প্রদান করে বিদায় নিচ্ছি। আমার বিশ্বাস, এ বিশাল গদ্য কাব্যটি আরও সুদীর্ঘকাল বাঙালি পাঠককে বিমুগ্ধ করে রাখবে—যেমনভাবে বিগতদিনগুলো আমাদের রেখেছে। পরিশেষে এককথায় বলতে পারি— 'বিশ্বনবী' আমার 'সুখকর' পাঠের মধ্যে একটি। 
আপনি সেই চাদর—
যে চাদর উম দেয়— দরদের ঘোর লাগায়।
আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। মস্তিষ্কের কোনায় কোনায় মায়ার খুশবু ছিটায়। নীরব নিবিড় দোলা দেয়— প্রাণে-প্রাণে, গানে-গানে, ফুলে-ফুলে।

রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা.................

৩০/১২/২১

মঙ্গলবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১

আমাদের প্রত্যেকের জীবনে,
নীরেন্দ্রনাথের বন্ধু— অমলকান্তি'র মতো একটা বন্ধু থাকে। 
থাকে—ই। 
যে— রোজ দেরি করে ক্লাসে আসে, পড়া পারে না। 
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে অবাক হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে।
যে— ডাক্তার, মাষ্টার, উকিল কিচ্ছু হতে চায় না। কিচ্ছু না।
যে শুধু রোদ্দুর হতে চায়— শুধুই রোদ্দুর। ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক— রোদ্দুর।

২৯/১২/২১

রমজানে মী-টাইম, উই-টাইম বের করা খুব টাফ ছিলো। রমজানের একটা ব্যস্ততা তো থাকেই তার সাথে সাথে সবার অফিসের কাজের চাপ। সবমিলিয়ে আমরা একসাথে থাকলে...